logo

কীট

(নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাংবাদিকের ডায়েরি থেকে)

                                                                        ৪ মার্চ, ২৫৩৭

আমি আমার দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে বহু আশ্চর্য ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি। সেসব ঘটনা এতটাই অভিঘাতী যে—তাৎক্ষণিক আতঙ্ক, আশঙ্কা ইত্যাদিকে ছাপিয়ে উঠেছে অপার বিস্ময়। পরে হয়তো কিছু ঘটনার প্রকৃত রহস্য অনেক অনুসন্ধানের ফলে উদঘাটিত হয়েছে; আবার কিছু ঘটনার ক্ষেত্রে তা হয়নি।

  তবে মানুষের শক্তি এবং মেধার প্রতি আমার অগাধ আস্থা। তাই আমার বিশ্বাস—এখনও যেসব রহস্য অমীমাংসিত রয়েছে, সেগুলোরও প্রকৃত যুক্তিনিষ্ঠ ব্যাখ্যা একদিন পাওয়া যাবে। কারণ, ‘অলৌকিক’ বলে বাস্তবে কিছু হয় না। হওয়া সম্ভব নয়। আর এই অলৌকিকতার আবরণ সরিয়ে যুক্তিনির্ভর সত্যকে বের করে আনাটাই আমার কাজ। হ্যাঁ, আমি বিশ্বাস করি যে—গোয়েন্দাদের মতো সাংবাদিকরাও আসলে সত্যসন্ধানী। সমাজের সঙ্গে সত্যের পরিচয় করিয়ে দেওয়ায় তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। অবশ্য যশের লোভে যেসব সাংবাদিক মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেয় এবং জনগণের সামনে ভুয়ো খবর তুলে ধরে, তাদের কথা আলাদা।

  কিছু কিছু খবর আছে, যেগুলো আমাদের শিহরিত করে তোলে। কখনও কখনও সেই শিহরন এতটাই প্রভাবশালী হয় যে, অতি মনোযোগী মানুষের পক্ষেও সাধারণ দৈনন্দিন চিন্তা-ভাবনায় মনোনিবেশ করাও কষ্টকর হয়ে ওঠে। সে এক অসহনীয় পরিস্থিতি… কিছুদিন এমন চলতে থাকে। তারপর একসময় তার রেশ কমে যায়। তখন আমাদের সেটাকে আর ততটাও আশ্চর্যজনক বলে মনে হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়—একশো বছর আগে মানুষ অটোমেটেড বাড়ি বা ব্রিজের কথা শুনে যতটা অবাক হয়েছিল, এখন কি আর ততটা হয়?

  অবশ্য যেখানে এত এত সাম্প্রতিকতম উদাহরণ আমাদের হাতের কাছে মজুত রয়েছে—সেখানে একশো বছর তো অনেক দূরের কথা হয়ে গেল…

  এই বছরদুয়েক আগেও আমরা এন-আই-সি-ইউ বা ‘ন্যানো ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিট’-এর কথা শুনে যতটা বিস্মিত হয়েছিলাম—এখন কি আর তার ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট আছে? নেই। কারণ, আর্থিকভাবে মোটামুটি স্বচ্ছলেরা অনেকেই খাবার, পোশাক ইত্যাদির মতো এন-আই-সি-ইউ কিনে ঘরে মজুত করে রেখেছে। আপৎকালীন অবস্থায় এটা ব্যবহারের জন্য তো কোনও এক্সপার্ট লাগবে না, শুধু ন্যানো অক্সিজেন পিলের মতো নাকে ঢুকিয়ে নিলেই এটা চালু হয়ে যাবে এবং নিজের কাজ করতে থাকবে।

  কিন্তু এসবের পাশাপাশি এমন কিছু ঘটনাও ঘটে, যাদের প্রতি বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটতেই চায় না। বরং যত তলিয়ে ভাবা যায়, ততই যেন বুদ্ধিসুদ্ধি গুলিয়ে ওঠে। তাদের পিছনের যুক্তিটা বুঝতে পারি, বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষতা উপলব্ধি করতে পারি, আবিষ্কারকদের শ্রম আর মেধার পরিমাণটা আন্দাজ করতে পারি—তবু এই বস্তুজগতে তাদের আবির্ভাবটাকেই যেন কেমন অলীক বলে মনে হয়!

  এখন আমার সামনে ঠিক তেমনই একটা জিনিস রাখা আছে। সৌজন্যে: ডক্টর রিচার্ড হেরিংটন (যিনি তিন বছর আগেই মানুষের গড় আয়ু অন্তত দশ বছর বৃদ্ধি করার উপায় নিয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা করার জন্য দ্বিতীয়বার নোবেল পুরস্কার পেলেন)।

  ডক্টর হেরিংটন যে এই সময়ের শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক এবং অত্যাশ্চর্য আবিষ্কারকদের মধ্যে একজন, সে ব্যাপারে অন্যান্যদের মতো আমারও কোনও দ্বিমত নেই। থাকার কথাও অবশ্য নয়। তিনি যে কেবল অত্যন্ত মেধাবী, শুধু তাই-ই নয়; তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি এবং কর্মপদ্ধতিও অভিনব। এই চুরাশি বছর বয়সেও তাঁর মেধা এবং বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসাতে এতটুকু ভাটা পড়েনি। যারাই তাঁর কাজকর্ম সম্পর্কে মোটামুটি ওয়াকিবহাল, তাঁর লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধ এবং গবেষণাপত্রগুলো নিয়মিত পড়ে থাকে—আশা করি তারা প্রত্যেকেই এই বিষয়ে আমার সঙ্গে একমত হবে। আর গতকালের ঘটনাটার পর তো এই নিয়ে আর কোনও সন্দেহই থাকা উচিত নয়।

  গতকাল ডক্টর হেরিংটন তাঁর বাসভবনে যে প্রেস-মিটের আয়োজন করেছিলেন, সেখানে আরও ডজনখানেক সাংবাদিকের মতো আমিও ছিলাম। এই বিষয়ে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। কারণ, প্রথমত বহু বিখ্যাত সংবাদপত্রও সেখানে আমন্ত্রণ পায়নি। আর দ্বিতীয়ত, আমাদের কাগজের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা সেখানে উপস্থিত থাকার যোগ্য প্রতিনিধি হিসাবে আমাকেই পছন্দ করেছিলেন। এই দুটো ফ্যাক্টর যদি একসঙ্গে কাজ না করত, তবে হয়তো স্বচক্ষে এই যুগান্তকারী ঘটনার সাক্ষী থাকার সুযোগ আমার হাত থেকে ফসকে যেত।

  হ্যাঁ, শুনলে হয়তো বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে; কিন্তু গতকাল যে ঘটনার সাক্ষী আমি হলাম—তা একটি যুগান্তকারী ঘটনাই বটে! অন্তত এর চেয়ে ভাল এবং মানানসই কোনও বিশেষণ আমার জানা নেই।

  ডক্টর হেরিংটন তো আর খোশগল্প করার জন্য আমাদের ডাকেননি। যাঁর জল পান করার সময়টুকু পর্যন্ত মাপা, লোক ডেকে গল্প করার সময় তাঁর কোথায়? তিনি আমাদের ডেকেছিলেন তাঁর নতুন আবিষ্কারের ব্যাপারে কিছু তথ্য আমাদের উপস্থিতিতে প্রথম জনসমক্ষে আনার উদ্দেশ্যে।

  নিঃসন্দেহে আবিষ্কারটি অত্যন্ত অভিনব এবং প্রয়োজনীয়।

  একটা বিষয়ে আমরা সবাই ওয়াকিবহাল, পৃথিবীর জনসংখ্যা এখন এত বেড়ে গেছে যে, বিগত কয়েক শতাব্দী ধরেই চাষের জমির অত্যন্ত সংকট দেখা দিয়েছে। তার মধ্যেও যেটুকু ফাঁকা জায়গা সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে—সেখানে প্রধানত অতি-উচ্চফলনশীল খাদ্যশস্য, ফল ইত্যাদি চাষ করা হচ্ছে। কিন্তু আরও কিছু কৃষিজ জিনিস, যেখানে গাছপালা অত্যন্ত প্রয়োজন—যেমন রেশম, মধু ইত্যাদি—সেসব চাষের ক্ষেত্রে এই স্থানাভাব ভীষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া, যেহেতু রেশম নিষ্কাশন করার সময় পিউপাদের অকালমৃত্যু ঘটে—তাই নৃশংসতা রোধক কমিটিও বহুকাল ধরে এই চাষের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে আসছে।

  উৎকৃষ্ট মধু যদিও বা কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা সম্ভব হয়েছে; কিন্তু ভাল মানের কৃত্রিম রেশম এখনও তৈরি করা সেভাবে সম্ভব হয়নি। অথচ অত্যাধুনিক অপারেশনগুলোর জন্য যে সুতো ব্যবহার করা হয়, ভিনগ্রহে অভিযান চালানো ল্যান্ডরোভারগুলোর চাকার ভিতরে যে বিশেষ আস্তরণ দেওয়া হয়, কিছু বিশেষ প্রকারের প্যারাসুট তৈরির জন্য যে কাপড় ব্যবহার করা হয়—সেসবকিছুর জন্য প্রাকৃতিক রেশম অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

  আর এই সমস্যারই সমাধান করতে চলেছে ডক্টর হেরিংটনের নতুন আবিষ্কার।

  ডক্টর হেরিংটন কোনও আশ্চর্য প্রযুক্তিতে রেশম মথের সিল্ক গ্ল্যান্ড বা রেশম গ্রন্থি মানুষের শরীরে স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছেন। আরও ভালভাবে বলতে গেলে, তিনি মানুষের লালাগ্রন্থির সঙ্গে বোম্বিক্স মোরির এক ইউনিভোল্টাইন ভ্যারাইটির রেশম গ্রন্থিকে কোনও আশ্চর্য উপায়ে জুড়ে দিয়েছেন। যদিও এই প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়ার খুঁটিনাটি নিয়ে তিনি গতকালের প্রেস-মিটে মুখ খোলেননি। এসব নাকি যথাসময়ে যাবতীয় ডিটেলস সমেত উপযুক্ত জায়গায় প্রকাশ পাবে। তাছাড়া এখনও নাকি চূড়ান্ত সাফল্য পেতে সামান্য কিছু ধাপ বাকি আছে; সেসব গুছিয়ে নিয়ে তবেই ডক্টর হেরিংটন প্রযুক্তিগত বিষয়গুলো প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে চান।

  আমিও এগুলো নিয়ে আর বিশেষ কোনও প্রশ্ন করিনি। বেশ বুঝতে পারছিলাম, ডক্টর হেরিংটন বিষয়টার মধ্যে কিছু তথ্যগত গোপনীয়তা রক্ষা করতে চাইছেন।

  তবে এত গোপনীয়তা রেখেও ডক্টর হেরিংটন যতটুকু মুখ খুলেছেন—তাতেই আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি।

  যেহেতু, এখন গিনিপিগ, ইঁদুর, খরগোশ ইত্যাদি নিম্নশ্রেণীর প্রাণীদের উপর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ফলাফল যাচাই করে দেখার নৃশংস পদ্ধতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়ে গেছে—তাই ডক্টর হেরিংটনও অন্যান্য বৈজ্ঞানিকদের মতো নিজের আবিষ্কার প্রথমে নিজের উপরেই প্রয়োগ করেছেন। অর্থাৎ, তিনি রেশম গ্রন্থির প্রথম প্রতিস্থাপনটা নিজের শরীরেই করেছেন।

  ‘মানুষের দ্বারা রেশম উৎপাদন…’ কথাটা প্রথমে শুনে, উপস্থিত সাংবাদিকদের অনেকের মুখেই একটা প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গের হাসি ফুটে উঠেছিল।

  মিথ্যে বলব না—বৈজ্ঞানিক হিসাবে ডক্টর হেরিংটনের শ্রেষ্ঠত্ব জানা সত্ত্বেও, একটা অবিশ্বাস আমার ভিতরেও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। জীব-জন্তুর অঙ্গ মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করা এক বিষয়; কিন্তু একটা কীটের দেহাঙ্গ মানুষের দেহে স্থাপন করা কি এতই সহজ? তার উপর সেটা এমনই একটা কাজ করে, যার সঙ্গে মানুষের স্বাভাবিক চরিত্রাবলির দূর-দূরান্ত পর্যন্ত কোনও সম্পর্ক নেই—তবে তো অবিশ্বাসের দিকে পাল্লা ভারী হওয়াটাই স্বাভাবিক!

  কিন্তু এরপরই আমাদের অবাক করে দিয়ে ডক্টর হেরিংটন সবার চোখের সামনে রেশম তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। আমরা দেখছিলাম, তাঁর মুখের ভিতর থেকে যথেষ্ট দ্রুতবেগে রেশম বেরিয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি কতকগুলো ছোট ছোট রেশমের গোলা তৈরি করে ফেলেছিলেন; এবং সেগুলো উপস্থিত কয়েকজন সাংবাদিককে উপহারও দিয়েছিলেন।

  আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান, কারণ আমিও একটা রেশমের গোলা পেয়েছিলাম।

  সেই রেশমের গোলাটা এখন রয়েছে আমার চোখের সামনে। আলো পড়ে সেটা ঠিক একদলা সোনার মতোই চকচক করছে। এত সুন্দর তার রং আর এমনই তার ঔজ্জ্বল্য যে—তার দিক থেকে চোখ ফেরানো দায়।

  ডক্টর হেরিংটন যখন রেশমের গোলাগুলি একেকজনের হাতে তুলে দিচ্ছিলেন, তারা বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সমস্ত ব্যঙ্গের হাসি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বরং এক প্রগাঢ় বিস্ময় আর সমীহের ভাব দেখা যাচ্ছিল প্রত্যেকের মধ্যে।

  ডক্টর হেরিংটনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে অবশ্য অনেক সাংবাদিকই তাঁর এই নতুন আবিষ্কারের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করছিল। তাদের ধারণা—ওসব রেশম গ্রন্থির প্রতিস্থাপন-ট্রতিস্থাপনের তত্ত্ব ভুয়ো; আসলে ডক্টর হেরিংটন নিজের গলায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোনও স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বসিয়েছেন, যার থেকে রেশমের কুণ্ডলী বেরিয়ে আসছে।

  আমার কিন্তু এই কথায় সায় নেই। কারণ, কাঁচা রেশম আমি অনেক দেখেছি। সেসবের সঙ্গে এই রেশমের বিস্তর ফারাক। কোনও সেরিকালচারিস্ট না হওয়া সত্ত্বেও একথা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি যে, বাজারে উপলব্ধ যে কোনও রেশমের থেকেই এই রেশমের গুণগত মান অনেক উন্নত। তাছাড়া এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের কৃতিত্ব রয়েছে যাঁর ঝুলিতে, তাঁর আর এসব লোক-হাসানো কাজ করে কী হবে?

  এসব কথা অবশ্য আমি আমার সহকর্মীদের বলিনি। এসবে শুধু শুধু কথা বাড়বে… কী প্রয়োজন অকারণ তর্কাতর্কিতে গিয়ে শুধু শুধু কিছুটা সময় নষ্ট করার?

  তাছাড়া আর মাস-খানেকের মধ্যেই তো ডক্টর হেরিংটনের রিসার্চ পেপার প্রকাশিত হবে। তখনই একেবারে হাতেনাতে প্রমাণ হয়ে যাবে—ব্যাপারটা সত্যি, নাকি বুজরুকি!

  আমার লক্ষ্য আপাতত অন্য জিনিসে।

  এরইমধ্যে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আগামী পরশু আমি ডক্টর হেরিংটনের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করতে পেরেছি। উফ্, বিগত প্রায় একবছর ধরে আমি এই সাক্ষাতের সুযোগটা পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে আসছিলাম।

  এ ব্যাপারেও ভাগ্য আমার সহায় বলতে হবে। কারণ, আজ পর্যন্ত হাতেগোনা কয়েকজন সাংবাদিকই ডক্টর হেরিংটনের সাক্ষাৎকার নিতে পেরেছে। ইন্টারভিউ ব্যাপারটাকে ডক্টর হেরিংটন প্রচণ্ড অপছন্দ করেন। ওঁর মতে, সুযোগ পেলেই নাকি সাংবাদিকরা এত অপ্রয়োজনীয় আর অর্থহীন কথা বলে যে, তাদের সঙ্গে কথা বলা মানে বৃথা কালক্ষেপ ছাড়া আর কিছু নয়।

  ডক্টর হেরিংটন অবশ্য খুব অল্প সময়ের জন্যই কথা বলতে রাজি হয়েছেন। এখন দেখা যাক—ওইটুকু সময়কেই কাজে লাগিয়ে আমি ওঁর থেকে নতুন কোনও তথ্য বের করতে পারি কি না!

                                                                        ৫ মার্চ, ২৫৩৭

যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টে নামার আগেই ভাল করে কিছু হোমওয়ার্ক করে নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার ক্ষেত্রে এবং সিরিয়াস কোনও প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পড়াশোনা করে নেওয়া খুবই দরকার। আমার শিক্ষক বলতেন, ফাঁকিবাজি করে আর যাই হোক, ভাল কাজ হয় না। আমি নিজে তো সবসময় এই তত্ত্বে বিশ্বাস করে এসেছি এবং ফলও পেয়েছি।

  এবারও আমি ডক্টর হেরিংটনের পূর্ববর্তী সমস্ত সাক্ষাৎকার খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। নিজের অ্যানালিসিস অনুযায়ী কিছু কিছু নোটও বানিয়েছি। সবকিছু দেখে আমার দুটো কথা মনে হয়েছে—

  ১. ডক্টর হেরিংটন তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, আত্মীয়-স্বজন ইত্যাদি নিয়ে বেশি কথা বলতে পছন্দ করেন না। বরং তার শিক্ষা, কাজকর্ম, পেশা ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন করলেই তিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হন।

  ২. অকারণ প্রশংসা করলে, অহেতুক বিতর্কমূলক প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে বা সমসাময়িক বৈজ্ঞানিকদেরকে নিয়ে মন্তব্য রাখতে বললে উনি অত্যন্ত বিরক্ত হন।

  আমি চেষ্টা করছি, এই বিষয়গুলোকে যথাসম্ভব পরিহার করে প্রশ্ন তৈরি করতে। ডক্টর হেরিংটনের কর্মজীবন এতই বৈচিত্রময় যে, এসব বাদ দিয়ে প্রশ্ন সাজাতে আমাকে খুব একটা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না।

  ডক্টর হেরিংটনের পারিবারিক জীবন সম্পর্কে তথ্য তো অনেক ওয়েবসাইটেই পাওয়া যায়। তাঁর বাবা-মা ছিলেন বৈজ্ঞানিক দম্পতি, যাঁরা ফুলারিন থেকে পরিবেশবান্ধব অথচ উচ্চ তাপশক্তিযুক্ত জ্বালানি তৈরি করে যুগ্মভাবে একবার নোবেল পেয়েছিলেন। তাছাড়া অধ্যাপক হিসাবেও তাঁদের যথেষ্ট সুনাম ছিল৷ তিনি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান।

  ডক্টর হেরিংটন কুইন্স মেরি স্কুল আর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে পড়াশোনা শেষ করেছেন। বর্তমানে তিনি স্ট্যানফোর্ডের বায়োটেকনোলজি ডিপার্টমেন্টের বিভাগীয় প্রধান হিসাবে নিযুক্ত। এছাড়া, তিনি অবিবাহিত, তাঁর দত্তক নেওয়া কোনও সন্তান নেই; সেরেঙ্গেটি ন্যাশনাল পার্কের উন্নতিকল্পে প্রায়শই তিনি দান-টান করে থাকেন। ব্যস্! এইটুকুই। অবশ্য এর বেশি ব্যক্তিগত তথ্য জেনে আমার হবেটাই বা কী? বরং সেসব জিজ্ঞাসা করা নিছক অসভ্যতা এবং সময়ের অপচয় ছাড়া কিছু নয়।

  আর সমসাময়িক বৈজ্ঞানিকদের সম্পর্কে তাঁর মতামতও খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। অন্তত আমার কাছে তো নয়-ই। যে কোনও প্রতিভাবানের প্রকৃত পরিচয় তাঁর নিজের কৃতিত্বে। অন্যরা তাঁর সম্পর্কে কী বলল, কী ভাবল, কেমন ধরনের মন্তব্য করল—তাতে কি খুব বড় কিছু যায়-আসে? আমার তো মনে হয় না। শেষ পর্যন্ত কর্মই নির্ধারণ করে দেয়, কার যোগ্যতা কতটা।

  কী কী জিজ্ঞাসা করব, সেসব গুছিয়ে নিয়ে আমি মোটামুটি একটা খসড়া তৈরি করেছি। আমাদের চিফ এডিটরকে সেটা দেখিয়েও নিয়েছি। তাঁরও প্রশ্নপত্র পছন্দ হয়েছে। এখন ডক্টর হেরিংটন উত্তরগুলো ঠিকঠাক দিলেই হল!

                                                                        ৬ মার্চ, ২৫৩৭

কিছুদিন হল, দাঁতের যন্ত্রণাটা প্রচণ্ড ভোগাচ্ছে। অ্যান্টি-পেইন সল্যুশন দিয়ে কুলকুচি করলে কিছুক্ষণ কম থাকছে, তারপর আবার মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। খাওয়া-ঘুমে তো ব্যাঘাত ঘটছেই, কাজকর্মে পর্যন্ত ঠিকঠাক মন বসাতে পারছি না।

  ওদিকে গতকাল খুব ঝামেলা গেছে। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের চব্বিশ তলায় গতকাল সন্ধ্যায় একটি অটোমেটেড ফ্লাইং উবের ধাক্কা লাগিয়ে ফেলেছে। অবশ্য বারান্দার কিছু কাচ ভাঙা ছাড়া তেমন কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি; তবু ঝামেলা হয়েছে যথেষ্ট। বাসিন্দারা তো খুবই ভয় পেয়েছে। পুলিশ অবশ্য গাড়িটাকে বাজেয়াপ্ত করেছে; সত্যি সত্যিই তাতে কোনও যান্ত্রিক গোলযোগ আছে, নাকি অন্য কোনও বিষয়—সেসব তারা খতিয়ে দেখবে। তবে এরইমধ্যে নাকি উবেরটির মালিক সব ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিয়েছেন এবং নিঃশর্ত ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছেন। 

  এদিকে আন্টার্কটিকার বরফ এবং হিমবাহ সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জ যে নতুন প্রকল্প ঘোষণা করেছে—সেটা নিয়ে দু’দিনের মধ্যে আমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখতে হবে। সেখানে ওখানকার প্রাণীজগৎ সংরক্ষণের বিষয়গুলোরও উল্লেখ রাখতে হবে। বিশেষ করে পেঙ্গুইন, তিমি আর সিলদের জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জ যে বিশেষ পদক্ষেপগুলো নিয়েছে—সেগুলোর বিষয়ে অন্তত কয়েকটা বাক্য তো খরচ করতেই হবে।

  এদিকে আমি লিখব কী—যন্ত্রণার চোটে ঠান্ডা মাথায় কিছু ভাবতেই পারছি না… অথচ সম্পাদক নাছোড়বান্দা। অন্য কারোরটা নয়, তিনি আমার লেখাই চান।

  আগামী পরশুর জন্য একজন ডেন্টিস্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করেছি। আজ-কালের মধ্যে হলে অবশ্য বেশি ভাল হত—সেক্ষেত্রে ইন্টারভিউটা নির্ঝঞ্ঝাটে নিতে পারতাম৷ কিন্তু আজ-কালের জন্য সমস্ত ডেন্টিস্টরা বুকড! যাইহোক, শেষ পর্যন্ত যে কিছু একটা ব্যবস্থা হতে চলেছে—এই-ই যথেষ্ট।

  এদিকে আজ বিকালে আবার ডক্টর হেরিংটনের সাক্ষাৎকার নিতে যাওয়া আছে। সেসময় যেন দাঁতের যন্ত্রণাটা বাড়াবাড়ি আকার ধারণ না করে, সেই জন্য একটা পেইন কিলার ডিভাইস দাঁতে লাগিয়ে নেব ভাবছি। কিন্তু এই ডিভাইসগুলো বেশিক্ষণ লাগিয়ে রাখলে নাকি মাড়ির স্বাভাবিক স্পর্শকাতরতা কমে যায়। যাক গে, আমি তো আর ঘণ্টাখানেকের বেশি রাখব না। তারপর, আশা করছি আগামী পরশু নাগাদ তো সব সমস্যা মিটেই যাবে!