logo

কীট

(নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাংবাদিকের ডায়েরি থেকে)

                                                                        ৪ মার্চ, ২৫৩৭

আমি আমার দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে বহু আশ্চর্য ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি। সেসব ঘটনা এতটাই অভিঘাতী যে—তাৎক্ষণিক আতঙ্ক, আশঙ্কা ইত্যাদিকে ছাপিয়ে উঠেছে অপার বিস্ময়। পরে হয়তো কিছু ঘটনার প্রকৃত রহস্য অনেক অনুসন্ধানের ফলে উদঘাটিত হয়েছে; আবার কিছু ঘটনার ক্ষেত্রে তা হয়নি।

  তবে মানুষের শক্তি এবং মেধার প্রতি আমার অগাধ আস্থা। তাই আমার বিশ্বাস—এখনও যেসব রহস্য অমীমাংসিত রয়েছে, সেগুলোরও প্রকৃত যুক্তিনিষ্ঠ ব্যাখ্যা একদিন পাওয়া যাবে। কারণ, ‘অলৌকিক’ বলে বাস্তবে কিছু হয় না। হওয়া সম্ভব নয়। আর এই অলৌকিকতার আবরণ সরিয়ে যুক্তিনির্ভর সত্যকে বের করে আনাটাই আমার কাজ। হ্যাঁ, আমি বিশ্বাস করি যে—গোয়েন্দাদের মতো সাংবাদিকরাও আসলে সত্যসন্ধানী। সমাজের সঙ্গে সত্যের পরিচয় করিয়ে দেওয়ায় তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। অবশ্য যশের লোভে যেসব সাংবাদিক মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেয় এবং জনগণের সামনে ভুয়ো খবর তুলে ধরে, তাদের কথা আলাদা।

  কিছু কিছু খবর আছে, যেগুলো আমাদের শিহরিত করে তোলে। কখনও কখনও সেই শিহরন এতটাই প্রভাবশালী হয় যে, অতি মনোযোগী মানুষের পক্ষেও সাধারণ দৈনন্দিন চিন্তা-ভাবনায় মনোনিবেশ করাও কষ্টকর হয়ে ওঠে। সে এক অসহনীয় পরিস্থিতি… কিছুদিন এমন চলতে থাকে। তারপর একসময় তার রেশ কমে যায়। তখন আমাদের সেটাকে আর ততটাও আশ্চর্যজনক বলে মনে হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়—একশো বছর আগে মানুষ অটোমেটেড বাড়ি বা ব্রিজের কথা শুনে যতটা অবাক হয়েছিল, এখন কি আর ততটা হয়?

  অবশ্য যেখানে এত এত সাম্প্রতিকতম উদাহরণ আমাদের হাতের কাছে মজুত রয়েছে—সেখানে একশো বছর তো অনেক দূরের কথা হয়ে গেল…

  এই বছরদুয়েক আগেও আমরা এন-আই-সি-ইউ বা ‘ন্যানো ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিট’-এর কথা শুনে যতটা বিস্মিত হয়েছিলাম—এখন কি আর তার ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট আছে? নেই। কারণ, আর্থিকভাবে মোটামুটি স্বচ্ছলেরা অনেকেই খাবার, পোশাক ইত্যাদির মতো এন-আই-সি-ইউ কিনে ঘরে মজুত করে রেখেছে। আপৎকালীন অবস্থায় এটা ব্যবহারের জন্য তো কোনও এক্সপার্ট লাগবে না, শুধু ন্যানো অক্সিজেন পিলের মতো নাকে ঢুকিয়ে নিলেই এটা চালু হয়ে যাবে এবং নিজের কাজ করতে থাকবে।

  কিন্তু এসবের পাশাপাশি এমন কিছু ঘটনাও ঘটে, যাদের প্রতি বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটতেই চায় না। বরং যত তলিয়ে ভাবা যায়, ততই যেন বুদ্ধিসুদ্ধি গুলিয়ে ওঠে। তাদের পিছনের যুক্তিটা বুঝতে পারি, বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষতা উপলব্ধি করতে পারি, আবিষ্কারকদের শ্রম আর মেধার পরিমাণটা আন্দাজ করতে পারি—তবু এই বস্তুজগতে তাদের আবির্ভাবটাকেই যেন কেমন অলীক বলে মনে হয়!

  এখন আমার সামনে ঠিক তেমনই একটা জিনিস রাখা আছে। সৌজন্যে: ডক্টর রিচার্ড হেরিংটন (যিনি তিন বছর আগেই মানুষের গড় আয়ু অন্তত দশ বছর বৃদ্ধি করার উপায় নিয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা করার জন্য দ্বিতীয়বার নোবেল পুরস্কার পেলেন)।

  ডক্টর হেরিংটন যে এই সময়ের শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক এবং অত্যাশ্চর্য আবিষ্কারকদের মধ্যে একজন, সে ব্যাপারে অন্যান্যদের মতো আমারও কোনও দ্বিমত নেই। থাকার কথাও অবশ্য নয়। তিনি যে কেবল অত্যন্ত মেধাবী, শুধু তাই-ই নয়; তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি এবং কর্মপদ্ধতিও অভিনব। এই চুরাশি বছর বয়সেও তাঁর মেধা এবং বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসাতে এতটুকু ভাটা পড়েনি। যারাই তাঁর কাজকর্ম সম্পর্কে মোটামুটি ওয়াকিবহাল, তাঁর লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধ এবং গবেষণাপত্রগুলো নিয়মিত পড়ে থাকে—আশা করি তারা প্রত্যেকেই এই বিষয়ে আমার সঙ্গে একমত হবে। আর গতকালের ঘটনাটার পর তো এই নিয়ে আর কোনও সন্দেহই থাকা উচিত নয়।

  গতকাল ডক্টর হেরিংটন তাঁর বাসভবনে যে প্রেস-মিটের আয়োজন করেছিলেন, সেখানে আরও ডজনখানেক সাংবাদিকের মতো আমিও ছিলাম। এই বিষয়ে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। কারণ, প্রথমত বহু বিখ্যাত সংবাদপত্রও সেখানে আমন্ত্রণ পায়নি। আর দ্বিতীয়ত, আমাদের কাগজের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা সেখানে উপস্থিত থাকার যোগ্য প্রতিনিধি হিসাবে আমাকেই পছন্দ করেছিলেন। এই দুটো ফ্যাক্টর যদি একসঙ্গে কাজ না করত, তবে হয়তো স্বচক্ষে এই যুগান্তকারী ঘটনার সাক্ষী থাকার সুযোগ আমার হাত থেকে ফসকে যেত।

  হ্যাঁ, শুনলে হয়তো বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে; কিন্তু গতকাল যে ঘটনার সাক্ষী আমি হলাম—তা একটি যুগান্তকারী ঘটনাই বটে! অন্তত এর চেয়ে ভাল এবং মানানসই কোনও বিশেষণ আমার জানা নেই।

  ডক্টর হেরিংটন তো আর খোশগল্প করার জন্য আমাদের ডাকেননি। যাঁর জল পান করার সময়টুকু পর্যন্ত মাপা, লোক ডেকে গল্প করার সময় তাঁর কোথায়? তিনি আমাদের ডেকেছিলেন তাঁর নতুন আবিষ্কারের ব্যাপারে কিছু তথ্য আমাদের উপস্থিতিতে প্রথম জনসমক্ষে আনার উদ্দেশ্যে।

  নিঃসন্দেহে আবিষ্কারটি অত্যন্ত অভিনব এবং প্রয়োজনীয়।

  একটা বিষয়ে আমরা সবাই ওয়াকিবহাল, পৃথিবীর জনসংখ্যা এখন এত বেড়ে গেছে যে, বিগত কয়েক শতাব্দী ধরেই চাষের জমির অত্যন্ত সংকট দেখা দিয়েছে। তার মধ্যেও যেটুকু ফাঁকা জায়গা সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে—সেখানে প্রধানত অতি-উচ্চফলনশীল খাদ্যশস্য, ফল ইত্যাদি চাষ করা হচ্ছে। কিন্তু আরও কিছু কৃষিজ জিনিস, যেখানে গাছপালা অত্যন্ত প্রয়োজন—যেমন রেশম, মধু ইত্যাদি—সেসব চাষের ক্ষেত্রে এই স্থানাভাব ভীষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া, যেহেতু রেশম নিষ্কাশন করার সময় পিউপাদের অকালমৃত্যু ঘটে—তাই নৃশংসতা রোধক কমিটিও বহুকাল ধরে এই চাষের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে আসছে।

  উৎকৃষ্ট মধু যদিও বা কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা সম্ভব হয়েছে; কিন্তু ভাল মানের কৃত্রিম রেশম এখনও তৈরি করা সেভাবে সম্ভব হয়নি। অথচ অত্যাধুনিক অপারেশনগুলোর জন্য যে সুতো ব্যবহার করা হয়, ভিনগ্রহে অভিযান চালানো ল্যান্ডরোভারগুলোর চাকার ভিতরে যে বিশেষ আস্তরণ দেওয়া হয়, কিছু বিশেষ প্রকারের প্যারাসুট তৈরির জন্য যে কাপড় ব্যবহার করা হয়—সেসবকিছুর জন্য প্রাকৃতিক রেশম অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

  আর এই সমস্যারই সমাধান করতে চলেছে ডক্টর হেরিংটনের নতুন আবিষ্কার।

  ডক্টর হেরিংটন কোনও আশ্চর্য প্রযুক্তিতে রেশম মথের সিল্ক গ্ল্যান্ড বা রেশম গ্রন্থি মানুষের শরীরে স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছেন। আরও ভালভাবে বলতে গেলে, তিনি মানুষের লালাগ্রন্থির সঙ্গে বোম্বিক্স মোরির এক ইউনিভোল্টাইন ভ্যারাইটির রেশম গ্রন্থিকে কোনও আশ্চর্য উপায়ে জুড়ে দিয়েছেন। যদিও এই প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়ার খুঁটিনাটি নিয়ে তিনি গতকালের প্রেস-মিটে মুখ খোলেননি। এসব নাকি যথাসময়ে যাবতীয় ডিটেলস সমেত উপযুক্ত জায়গায় প্রকাশ পাবে। তাছাড়া এখনও নাকি চূড়ান্ত সাফল্য পেতে সামান্য কিছু ধাপ বাকি আছে; সেসব গুছিয়ে নিয়ে তবেই ডক্টর হেরিংটন প্রযুক্তিগত বিষয়গুলো প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে চান।

  আমিও এগুলো নিয়ে আর বিশেষ কোনও প্রশ্ন করিনি। বেশ বুঝতে পারছিলাম, ডক্টর হেরিংটন বিষয়টার মধ্যে কিছু তথ্যগত গোপনীয়তা রক্ষা করতে চাইছেন।

  তবে এত গোপনীয়তা রেখেও ডক্টর হেরিংটন যতটুকু মুখ খুলেছেন—তাতেই আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি।

  যেহেতু, এখন গিনিপিগ, ইঁদুর, খরগোশ ইত্যাদি নিম্নশ্রেণীর প্রাণীদের উপর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ফলাফল যাচাই করে দেখার নৃশংস পদ্ধতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়ে গেছে—তাই ডক্টর হেরিংটনও অন্যান্য বৈজ্ঞানিকদের মতো নিজের আবিষ্কার প্রথমে নিজের উপরেই প্রয়োগ করেছেন। অর্থাৎ, তিনি রেশম গ্রন্থির প্রথম প্রতিস্থাপনটা নিজের শরীরেই করেছেন।

  ‘মানুষের দ্বারা রেশম উৎপাদন…’ কথাটা প্রথমে শুনে, উপস্থিত সাংবাদিকদের অনেকের মুখেই একটা প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গের হাসি ফুটে উঠেছিল।

  মিথ্যে বলব না—বৈজ্ঞানিক হিসাবে ডক্টর হেরিংটনের শ্রেষ্ঠত্ব জানা সত্ত্বেও, একটা অবিশ্বাস আমার ভিতরেও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। জীব-জন্তুর অঙ্গ মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করা এক বিষয়; কিন্তু একটা কীটের দেহাঙ্গ মানুষের দেহে স্থাপন করা কি এতই সহজ? তার উপর সেটা এমনই একটা কাজ করে, যার সঙ্গে মানুষের স্বাভাবিক চরিত্রাবলির দূর-দূরান্ত পর্যন্ত কোনও সম্পর্ক নেই—তবে তো অবিশ্বাসের দিকে পাল্লা ভারী হওয়াটাই স্বাভাবিক!

  কিন্তু এরপরই আমাদের অবাক করে দিয়ে ডক্টর হেরিংটন সবার চোখের সামনে রেশম তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। আমরা দেখছিলাম, তাঁর মুখের ভিতর থেকে যথেষ্ট দ্রুতবেগে রেশম বেরিয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি কতকগুলো ছোট ছোট রেশমের গোলা তৈরি করে ফেলেছিলেন; এবং সেগুলো উপস্থিত কয়েকজন সাংবাদিককে উপহারও দিয়েছিলেন।

  আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান, কারণ আমিও একটা রেশমের গোলা পেয়েছিলাম।

  সেই রেশমের গোলাটা এখন রয়েছে আমার চোখের সামনে। আলো পড়ে সেটা ঠিক একদলা সোনার মতোই চকচক করছে। এত সুন্দর তার রং আর এমনই তার ঔজ্জ্বল্য যে—তার দিক থেকে চোখ ফেরানো দায়।

  ডক্টর হেরিংটন যখন রেশমের গোলাগুলি একেকজনের হাতে তুলে দিচ্ছিলেন, তারা বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সমস্ত ব্যঙ্গের হাসি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বরং এক প্রগাঢ় বিস্ময় আর সমীহের ভাব দেখা যাচ্ছিল প্রত্যেকের মধ্যে।

  ডক্টর হেরিংটনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে অবশ্য অনেক সাংবাদিকই তাঁর এই নতুন আবিষ্কারের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করছিল। তাদের ধারণা—ওসব রেশম গ্রন্থির প্রতিস্থাপন-ট্রতিস্থাপনের তত্ত্ব ভুয়ো; আসলে ডক্টর হেরিংটন নিজের গলায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোনও স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বসিয়েছেন, যার থেকে রেশমের কুণ্ডলী বেরিয়ে আসছে।

  আমার কিন্তু এই কথায় সায় নেই। কারণ, কাঁচা রেশম আমি অনেক দেখেছি। সেসবের সঙ্গে এই রেশমের বিস্তর ফারাক। কোনও সেরিকালচারিস্ট না হওয়া সত্ত্বেও একথা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি যে, বাজারে উপলব্ধ যে কোনও রেশমের থেকেই এই রেশমের গুণগত মান অনেক উন্নত। তাছাড়া এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের কৃতিত্ব রয়েছে যাঁর ঝুলিতে, তাঁর আর এসব লোক-হাসানো কাজ করে কী হবে?

  এসব কথা অবশ্য আমি আমার সহকর্মীদের বলিনি। এসবে শুধু শুধু কথা বাড়বে… কী প্রয়োজন অকারণ তর্কাতর্কিতে গিয়ে শুধু শুধু কিছুটা সময় নষ্ট করার?

  তাছাড়া আর মাস-খানেকের মধ্যেই তো ডক্টর হেরিংটনের রিসার্চ পেপার প্রকাশিত হবে। তখনই একেবারে হাতেনাতে প্রমাণ হয়ে যাবে—ব্যাপারটা সত্যি, নাকি বুজরুকি!

  আমার লক্ষ্য আপাতত অন্য জিনিসে।

  এরইমধ্যে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আগামী পরশু আমি ডক্টর হেরিংটনের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করতে পেরেছি। উফ্, বিগত প্রায় একবছর ধরে আমি এই সাক্ষাতের সুযোগটা পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে আসছিলাম।

  এ ব্যাপারেও ভাগ্য আমার সহায় বলতে হবে। কারণ, আজ পর্যন্ত হাতেগোনা কয়েকজন সাংবাদিকই ডক্টর হেরিংটনের সাক্ষাৎকার নিতে পেরেছে। ইন্টারভিউ ব্যাপারটাকে ডক্টর হেরিংটন প্রচণ্ড অপছন্দ করেন। ওঁর মতে, সুযোগ পেলেই নাকি সাংবাদিকরা এত অপ্রয়োজনীয় আর অর্থহীন কথা বলে যে, তাদের সঙ্গে কথা বলা মানে বৃথা কালক্ষেপ ছাড়া আর কিছু নয়।

  ডক্টর হেরিংটন অবশ্য খুব অল্প সময়ের জন্যই কথা বলতে রাজি হয়েছেন। এখন দেখা যাক—ওইটুকু সময়কেই কাজে লাগিয়ে আমি ওঁর থেকে নতুন কোনও তথ্য বের করতে পারি কি না!

                                                                        ৫ মার্চ, ২৫৩৭

যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টে নামার আগেই ভাল করে কিছু হোমওয়ার্ক করে নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার ক্ষেত্রে এবং সিরিয়াস কোনও প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পড়াশোনা করে নেওয়া খুবই দরকার। আমার শিক্ষক বলতেন, ফাঁকিবাজি করে আর যাই হোক, ভাল কাজ হয় না। আমি নিজে তো সবসময় এই তত্ত্বে বিশ্বাস করে এসেছি এবং ফলও পেয়েছি।

  এবারও আমি ডক্টর হেরিংটনের পূর্ববর্তী সমস্ত সাক্ষাৎকার খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। নিজের অ্যানালিসিস অনুযায়ী কিছু কিছু নোটও বানিয়েছি। সবকিছু দেখে আমার দুটো কথা মনে হয়েছে—

  ১. ডক্টর হেরিংটন তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, আত্মীয়-স্বজন ইত্যাদি নিয়ে বেশি কথা বলতে পছন্দ করেন না। বরং তার শিক্ষা, কাজকর্ম, পেশা ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন করলেই তিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হন।

  ২. অকারণ প্রশংসা করলে, অহেতুক বিতর্কমূলক প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে বা সমসাময়িক বৈজ্ঞানিকদেরকে নিয়ে মন্তব্য রাখতে বললে উনি অত্যন্ত বিরক্ত হন।

  আমি চেষ্টা করছি, এই বিষয়গুলোকে যথাসম্ভব পরিহার করে প্রশ্ন তৈরি করতে। ডক্টর হেরিংটনের কর্মজীবন এতই বৈচিত্রময় যে, এসব বাদ দিয়ে প্রশ্ন সাজাতে আমাকে খুব একটা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না।

  ডক্টর হেরিংটনের পারিবারিক জীবন সম্পর্কে তথ্য তো অনেক ওয়েবসাইটেই পাওয়া যায়। তাঁর বাবা-মা ছিলেন বৈজ্ঞানিক দম্পতি, যাঁরা ফুলারিন থেকে পরিবেশবান্ধব অথচ উচ্চ তাপশক্তিযুক্ত জ্বালানি তৈরি করে যুগ্মভাবে একবার নোবেল পেয়েছিলেন। তাছাড়া অধ্যাপক হিসাবেও তাঁদের যথেষ্ট সুনাম ছিল৷ তিনি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান।

  ডক্টর হেরিংটন কুইন্স মেরি স্কুল আর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে পড়াশোনা শেষ করেছেন। বর্তমানে তিনি স্ট্যানফোর্ডের বায়োটেকনোলজি ডিপার্টমেন্টের বিভাগীয় প্রধান হিসাবে নিযুক্ত। এছাড়া, তিনি অবিবাহিত, তাঁর দত্তক নেওয়া কোনও সন্তান নেই; সেরেঙ্গেটি ন্যাশনাল পার্কের উন্নতিকল্পে প্রায়শই তিনি দান-টান করে থাকেন। ব্যস্! এইটুকুই। অবশ্য এর বেশি ব্যক্তিগত তথ্য জেনে আমার হবেটাই বা কী? বরং সেসব জিজ্ঞাসা করা নিছক অসভ্যতা এবং সময়ের অপচয় ছাড়া কিছু নয়।

  আর সমসাময়িক বৈজ্ঞানিকদের সম্পর্কে তাঁর মতামতও খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। অন্তত আমার কাছে তো নয়-ই। যে কোনও প্রতিভাবানের প্রকৃত পরিচয় তাঁর নিজের কৃতিত্বে। অন্যরা তাঁর সম্পর্কে কী বলল, কী ভাবল, কেমন ধরনের মন্তব্য করল—তাতে কি খুব বড় কিছু যায়-আসে? আমার তো মনে হয় না। শেষ পর্যন্ত কর্মই নির্ধারণ করে দেয়, কার যোগ্যতা কতটা।

  কী কী জিজ্ঞাসা করব, সেসব গুছিয়ে নিয়ে আমি মোটামুটি একটা খসড়া তৈরি করেছি। আমাদের চিফ এডিটরকে সেটা দেখিয়েও নিয়েছি। তাঁরও প্রশ্নপত্র পছন্দ হয়েছে। এখন ডক্টর হেরিংটন উত্তরগুলো ঠিকঠাক দিলেই হল!

                                                                        ৬ মার্চ, ২৫৩৭

কিছুদিন হল, দাঁতের যন্ত্রণাটা প্রচণ্ড ভোগাচ্ছে। অ্যান্টি-পেইন সল্যুশন দিয়ে কুলকুচি করলে কিছুক্ষণ কম থাকছে, তারপর আবার মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। খাওয়া-ঘুমে তো ব্যাঘাত ঘটছেই, কাজকর্মে পর্যন্ত ঠিকঠাক মন বসাতে পারছি না।

  ওদিকে গতকাল খুব ঝামেলা গেছে। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের চব্বিশ তলায় গতকাল সন্ধ্যায় একটি অটোমেটেড ফ্লাইং উবের ধাক্কা লাগিয়ে ফেলেছে। অবশ্য বারান্দার কিছু কাচ ভাঙা ছাড়া তেমন কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি; তবু ঝামেলা হয়েছে যথেষ্ট। বাসিন্দারা তো খুবই ভয় পেয়েছে। পুলিশ অবশ্য গাড়িটাকে বাজেয়াপ্ত করেছে; সত্যি সত্যিই তাতে কোনও যান্ত্রিক গোলযোগ আছে, নাকি অন্য কোনও বিষয়—সেসব তারা খতিয়ে দেখবে। তবে এরইমধ্যে নাকি উবেরটির মালিক সব ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিয়েছেন এবং নিঃশর্ত ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছেন। 

  এদিকে আন্টার্কটিকার বরফ এবং হিমবাহ সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জ যে নতুন প্রকল্প ঘোষণা করেছে—সেটা নিয়ে দু’দিনের মধ্যে আমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখতে হবে। সেখানে ওখানকার প্রাণীজগৎ সংরক্ষণের বিষয়গুলোরও উল্লেখ রাখতে হবে। বিশেষ করে পেঙ্গুইন, তিমি আর সিলদের জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জ যে বিশেষ পদক্ষেপগুলো নিয়েছে—সেগুলোর বিষয়ে অন্তত কয়েকটা বাক্য তো খরচ করতেই হবে।

  এদিকে আমি লিখব কী—যন্ত্রণার চোটে ঠান্ডা মাথায় কিছু ভাবতেই পারছি না… অথচ সম্পাদক নাছোড়বান্দা। অন্য কারোরটা নয়, তিনি আমার লেখাই চান।

  আগামী পরশুর জন্য একজন ডেন্টিস্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করেছি। আজ-কালের মধ্যে হলে অবশ্য বেশি ভাল হত—সেক্ষেত্রে ইন্টারভিউটা নির্ঝঞ্ঝাটে নিতে পারতাম৷ কিন্তু আজ-কালের জন্য সমস্ত ডেন্টিস্টরা বুকড! যাইহোক, শেষ পর্যন্ত যে কিছু একটা ব্যবস্থা হতে চলেছে—এই-ই যথেষ্ট।

  এদিকে আজ বিকালে আবার ডক্টর হেরিংটনের সাক্ষাৎকার নিতে যাওয়া আছে। সেসময় যেন দাঁতের যন্ত্রণাটা বাড়াবাড়ি আকার ধারণ না করে, সেই জন্য একটা পেইন কিলার ডিভাইস দাঁতে লাগিয়ে নেব ভাবছি। কিন্তু এই ডিভাইসগুলো বেশিক্ষণ লাগিয়ে রাখলে নাকি মাড়ির স্বাভাবিক স্পর্শকাতরতা কমে যায়। যাক গে, আমি তো আর ঘণ্টাখানেকের বেশি রাখব না। তারপর, আশা করছি আগামী পরশু নাগাদ তো সব সমস্যা মিটেই যাবে!

বিদ্যাস্থানে ভয়

এক

ছুটি পড়ে যাচ্ছে আজ থেকেই। তবে ছুটি পড়ার সেই আগের মজাটা এখন আর নেই। আগের মতো লম্বা এক মাসের ছুটি এখন আর পড়ে না। এখন ছুটি দশ থেকে এগারো দিনের মতো। ষষ্ঠী থেকে লক্ষ্মী পুজো। তবু পুজোর ছুটি তো… পুজো এলেই বাঙালি আকাশে পুজো পুজো রং দেখে, বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ পায়।

এখন সবে দুটো বাজলেও কলেজ তাই ভাঙা হাট। ছেলেমেয়েরা ক্লাসে নেই। টিচাররাও তাই একে একে ব্যাগ গোটাতে শুরু করেছে। আজ কলেজও সময়ের বাঁধন রাখেনি। অসিতও তাই উঠব উঠব করছিল। এমন সময়ই বিশু এল, “স্যর…”

কলম থামিয়ে অসিত মাথা তুলল, “কী রে, আয়।” বিশু ঘরে ঢুকে এল। এটা ওদের ডিপার্টমেন্টের নিজস্ব ঘর। প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টেরই আলাদা আলাদা রুম। টিচাররা বসেন। আগে কমন স্টাফ রুম ছিল। এই প্রিন্সিপাল এসে এসব বন্দোবস্ত করেছেন। সবাই খুব খুশি। অসিত শুধু বলে, ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল।’

ঘরে ঢুকে টেবিলের উলটো দিকে দাঁড়িয়ে বিশু হাতের কাগজটা এগিয়ে দিল, “স্যর এটা একটু করে দিয়ে যেতে বললেন।”

হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিতে নিতে অসিত বলল, “বাড়ি যাবি না?”

“কাল সকালে। আসছি স্যর,” বলে বিশু চলে গেল। যেন রাজ্যের কাজ পড়ে আছে তার।

অসিত খাতা-পেন গুটিয়ে উঠে পড়ল। কম্পিউটারে বসতে হবে। ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্টদের রেজিস্ট্রেশন-এর কাগজপত্র। ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে আপলোড করতে হবে। সময় লাগবে। অসিত বুঝতে পারছিল, এটা ওকে কলেজে আরও কিছুক্ষণ আটকে রাখার ফন্দি মাত্র। আজ যেহেতু পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখার রাস্তা নেই, সেজন্য এই বন্দোবস্ত। এতে যে ভদ্রলোক কী আনন্দ পান কে জানে! “পাগলের গো-বধেও আনন্দ,” কম্পিউটারের স্যুইচ অন করতে করতে স্বগতোক্তি করল অসিত।

প্রায় দু’ঘণ্টা টানা কাজ করে যখন উঠল, ঘাড় মাথা তখন টনটন করছে। এতক্ষণ একটানা কম্পিউটারে কাজ করার অভ্যেস ওর নেই। উঠল, অ্যাটাচড বাথরুমে গিয়ে চোখে-মুখে জল দিল, তারপর ডিপার্টমেন্ট লক করে বাইরে এল।

         করিডর দিয়ে হেঁটে অফিসের দিকে যাবার পথে অসিত টের পাচ্ছিল পুরো কলেজ ফাঁকা। ওদের ডিপার্টমেন্ট কলেজের এমন এক কোণে যেখানে না ঢোকে আলো, না ঢোকে হাওয়া, না পৌঁছায় কলেজের কোনও কোলাহল। কেমন যেন এক হালকা আশঙ্কা হল অসিতের, অফিসে আর কেউ আছে তো, নাকি ওর কথা ভুলে গিয়ে সব চাবি মেরে কেটে পড়েছে!

 তিনতলার সিঁড়ির মুখে এসে একটা গাড়ির আওয়াজ পেল অসিত। মানে কেউ একজন বেরচ্ছে। অসিত বলে, গ্যাং অফ সেভেন। প্রিন্সিপাল সহ সাতজনের এই মধুচক্র বসে কলেজ একটু হালকা হয়ে যাবার পর। কোত্থেকে কী ফান্ড আসবে, আর সেই ফান্ড কোন পথে কোথায় পাঠাতে হবে, তার অনুপুঙ্খ পরিকল্পনা তৈরি হয় এই মধুচক্রের বৈঠকে। তারপর এক এক করে বেরতে শুরু করে গাড়িগুলি। অসিত এই মধুচক্রের চক্ষুশূল। গভর্নিং বডির মেম্বার হওয়ার সূত্রে ইদানীং তার ভার সহ্য করতে হচ্ছে এই গ্যাং অফ সেভেনকে। 

 দোতলায় নেমে, অফিসে কাগজপত্র জমা দিয়ে একতলার সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতেই অসিত দেখল আরেকটা গাড়ি বেরচ্ছে। এগুলো কোনটা যে কার গাড়ি অসিত বোঝে না। সব একই মডেলের। রং আলাদা আলাদা অবশ্য। তবে সেসব রঙের পার্থক্য ওর মাথায় ঢোকে না। কার গাড়ি বের হচ্ছে সেটাও বোঝার উপায় নেই। সব গাড়িরই কালো কাচ। বাইরে থেকে বোঝা যায় না ভিতরে কে আছে।

অসিত সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাগানের পাশের রাস্তাতে পা রাখতেই গাড়িটার ড্রাইভারের কাচ নামল, “স্যর, উঠে পড়ুন।” অর্থাৎ গাড়ির মালিক অর্ডার দিয়েছেন। অসিত পারতপক্ষে এসব গাড়িতে ওঠে না। সে পদাতিক। পায়ে হেঁটেই কলেজ যাতায়াত করে। মোটে তো দু’ কিলোমিটার রাস্তা। আজ কী মনে হল, ঘাড়ে মাথায় যন্ত্রণাটা করছে বলেই বোধহয়… অসিত পিছনের দরজার লক ঘোরালো।

 মাথা নীচু করে শরীরটা গাড়ির মধ্যে গলাতে না গলাতেই একটা হাত রুমাল দিয়ে ওর চোখ-মুখ চেপে ধরল। লোকটার মুখে মাস্ক। লোকটাকে চিনে ওঠার আগেই নাকে একটা মিষ্টি গন্ধ পেল অসিত। আস্তে আস্তে ওর চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। 

দুই

পুজোর ছুটির পর সদ্য আজই কলেজ খুলেছে। এবারের পুজো হল বেশ দেরিতে। অক্টোবরের শেষে। তাতেও জলে-কাদায় নাকালের একশেষ। সৌজন্যে বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণাবর্ত, নিম্নচাপ। আর সেই নিম্নচাপের বর্ষার লেজ ধরে গুটি গুটি পায়ে এসে হাজির হালকা শীত।

          কলেজ থেকে ফিরে জমিয়ে চা-মুড়ি খাবার আগে তাই ছোটকা মায়ের কাছ থেকে ওর ঢাউস সুতির চাদরটা চেয়ে নিয়েছে। ভাল করে মুড়িয়ে বসে খেতে খেতে কাগজ পড়বে। কলেজ আমারও খুলেছে। আমি ফিরেছি অনেকক্ষণ আগেই। তবে আগে ফিরলেও বরাবরই আমি টুকটাক খেয়ে কাটিয়ে দিই, ছোটকার সঙ্গে বসে একসঙ্গে মুড়ি খাব বলে।

          একসঙ্গে খাওয়া মানে যে গল্প করতে করতে খাওয়া তা নয়। কাগজটা ভাগাভাগি করে একসঙ্গে পড়ি, পড়তে পড়তে কিছু মনে হলে মন্তব্য করি। গল্পটা জমে খাবার পর চায়ে চুমুক দিয়ে। খাবার মুখে নিয়ে কথা বলাটা ছোটকা বিশেষ পছন্দ করে না।

          তবে সেই গল্পটা আজ আর জমলো না। চায়ে প্রথম চুমুকটা দেবার পরই ছোটকার মোবাইলটা বেজে উঠল। ‘আননোন নাম্বার’, সেটা ছোটকার গলার অনিশ্চিত সাড়া শুনেই বুঝলাম। কিন্তু দু’-এক কথার পর সেটা অন্য দিকে ঘুরে গেল। আর আমি চমকে উঠলাম ছোটকা হঠাৎ করে মোবাইলের লাউড-স্পিকার অন করে দেওয়ায়, যেটা ও করে কোনও কেস চলার সময়।

“কী-রে এখন কেমন আছিস?”

“ভাল নেই অরিন্দমদা। আমার ভীষণ ভয় করছে।”

“আমি শুনলাম। রিনা বলল। তুই ডিটেইলটা বল। আর ভয়ের কী আছে? কিস্যু নেই।”

          কিন্তু ভদ্রলোক তারপর যেটা বললেন, সেটা যে আতঙ্কিত হয়ে পড়ার মতোই ঘটনা তা নিয়ে আমার অন্তত কোনও দ্বিধা রইল না। ভদ্রলোক মানে সুবীরকাকু। কাকু পড়ায় রামনগর নামের এক মফস্বল শহরের কলেজে। জুলজির অধ্যাপক। ওঁর কলেজে এক ভদ্রলোক পড়াতেন। অসিত বসু। অর্থনীতির অধ্যাপক। পড়াতেন মানে, পুজোর ছুটি পড়ার দিন তাঁকে শেষ দেখা গেছে কলেজেই। তারপরই তিনি নিখোঁজ। কলেজের মৌচাকে ঢিল মারার অভ্যাস ছিল তাঁর। ফলে কলেজের মধুচক্রের পাণ্ডাদের তিনি চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন। তারপরই হঠাৎ করে কলেজ থেকেই তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার পর সুবীরকাকুর একটা সন্দেহ হচ্ছিলই। আজ কলেজ খোলার পর ডিপার্টমেন্টে ঢুকেই কাকু দেখে দেওয়ালে একটা নতুন হিউম্যান স্কেলেটন ঝুলছে। দেখেই সন্দেহ শুধু নয়, প্রবল আতঙ্কে অজ্ঞান হয়ে যায় কাকু। কলেজ থেকেই তারপর গাড়িতে করে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এখন বাড়িতে।

 “কিন্তু তোর হঠাৎ এমন উদ্ভট সন্দেহ হল কেন?”

 “আমি ডিপার্টমেন্টের হেড অরিন্দম। এমন কোনও স্যাম্পেলের রিকুইজিশন তো আমি দিইনি।”

ছোটকার মুখটা একটু গম্ভীর হল। ফোনটা খানিকক্ষণ হাতেই ধরে রেখে তারপর বলল, “হতে পারে, তোর ডিপার্টমেন্টের অন্য কেউ প্রিন্সিপালের কাছে গিয়ে ভার্বালি অ্যাপ্রোচ করেছে। জিনিসটা দরকার।” 

“হতে পারে না।”

“কেন? তোদের সিলেবাসে হিউম্যান অ্যানাটমি নেই?”

“আছে।”

“পড়ায় কে? তুই?”

“না আমি নই। অনন্ত।”

“তাহলে তো হতেই পারে।”

“পারে না অরিন্দম। আমি ছাড়া ডিপার্টমেন্টে কোনও পার্মানেন্ট টিচার নেই। সেটা হলেও একটা কথা ছিল।” 

“বেশ, তাই না হয় হল। কিন্তু তোর হঠাৎ মনে হল কেন ওটা অসিতবাবুর স্কেলেটন? অসিতবাবু তো মিসিং।”

          আবার গলাটা কেমন হয়ে গেল সুবীরকাকুর। ফিসফিস করছে। যেন ফোনেই কেউ শুনে ফেলবে। “সেই একই হাইট অরিন্দম। অসিতদার কাঁধটা একটু চওড়া ছিল।” 

         “ধ্যাৎ, যত্তসব। বি নর্মাল সুবীর।” ছোটকা সুবীরকাকুর ভয়টাকে যেন উড়িয়ে দিতে চাইল।

কিন্তু হঠাৎই যেন আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল সুবীরকাকুর গলা। “অরিন্দম, অসিতদার বাঁ-হাতে ছ’টা আঙুল ছিল। সবটাই এমন মিলে যেতে পারে বলছিস!”

         ছোটকার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল।

তিন

গম্ভীর মুখে ছোটকা ফোনটা কেটে দেওয়ার সময়ই বুঝেছিলাম কেসটা এসে গেল। বিনি পয়সার কেস। বন্ধু তো আর পয়সা দেবে না। আর দিলেও ছোটকা নেবে না। তাছাড়া নেশার পিছনে ছোটার জন্য ছোটকা পয়সার তোয়াক্কা করে না। অবশ্য সে আর কেই বা করে নেশার জন্য?

          তবে এবার যে কিঞ্চিৎ ছোটাছুটি আছে সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। রামনগর কলকাতা থেকে আশি-নব্বই কিলোমিটার হবে। একবার গিয়েছিলাম ছোটকার সঙ্গে। সুবীরকাকুর বাড়িতেই উঠেছিলাম। ছোটাছুটি আছে এ-ও যেমন বুঝছিলাম, তেমনই ফোনটা রাখার পর ছোটকার ক্রমশ কুঁচকে ওঠা ভুরু থেকে বুঝতে পারছিলাম, ছোটাছুটি শুরু হবার দেরিও আর নেই।

         তবে সেটা যে এত তাড়াতাড়ি তাও বুঝতে পারিনি। সন্ধের পর থেকে ছোটকা আর আমার সঙ্গে কথা বলেনি। রাতে খাবার টেবিলে বসে বলল, “খেয়ে উঠে একবার দেখিস তো, সকালের দিকে রামনগর যাওয়ার কী বাস আছে এসবিএসটিসি-র।” 

         ব্যাস, ওই একটাই কথা। আমিও আর কথা বাড়াইনি। বুঝতে পারছিলাম, ও গভীরভাবে ভাবছে। খেয়ে উঠে এসবিএসটিসি-র অ্যাপটা খুলে ওকে সকালের দিকের বাসের টাইমগুলো জানাতে ও বলল, “সাড়ে ছ’টার বাসের টিকিট বুক করে নে।” 

রামনগর কলেজটা বেশ বড়। একটা মফস্বল শহরে যে এত বড় একটা কলেজ থাকতে পারে সেটা না দেখলে বিশ্বাস হত না। অথবা মফস্বল শহর বলেই হয়তো বা এত বড় কলেজ। কলকাতা শহরে এতটা জায়গা পাবে কোথায় কোনও কলেজ? 

          সুবীরকাকুকে বলাই ছিল, আমরা বেশিক্ষণ থাকব না। তাই ও যেন দেরি না করে। বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষা না করে আমরা তাই একটা টোটো ভাড়া করেই চলে এসেছি। টোটোর ভাড়া মেটাতে মেটাতে কাকু বলল, “দশ বছর আগেও কিন্তু কলেজ এত বড় ছিল না। আমি এসেও চালাঘরে ক্লাস করেছি। সব এই প্রিন্সিপালের উদ্যোগ।”

         “করিৎকর্মা লোক বলতে হবে তাহলে,” ছোটকার মন্তব্য শুনে সুবীরকাকু ম্লান হাসল। “চলো, তোমাদের ডিপার্টমেন্টে বসিয়ে আমি স্টাফ-রুমে সইটা সেরে আসব। সময়টা নষ্ট হবে না।”

“সই! কীসের সই?”

“অ্যারাইভালের। তোমরা এসব আর কী বুঝবে অরিন্দমদা? পাঁচ ঘণ্টা এখানে বন্দি হয়ে থাকা কম্পালসারি। ক্লাস থাকুক আর নাই থাকুক।”

          ছোটকা চুপ করে গেল। কলেজ নিয়ে সুবীরকাকুর চাপা ক্ষোভটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। সেটাকে খামোখা ঘাঁটিয়ে তোলার কোনও মানে হয় না।

         সুবীরকাকুর ডিপার্টমেন্টটা দোতলায়। ল্যাব-বেসড ডিপার্টমেন্ট বলে নন-টিচিং অ্যাটেনডেন্টও আছে। তাদের সঙ্গে, “আমার বন্ধু, অরিন্দমদা কলকাতার কলেজে আছে, বেড়াতে এসেছিল, আমাদের কলেজটা একটু দেখে ফিরে যাবে,” বলে আমাদের পরিচয় করে দিয়ে কাকু সই করতে চলে গেল।

 দুটো বিশাল বড় ঘর জুড়ে ডিপার্টমেন্ট। তুলনামূলকভাবে ছোট ঘরটায় টিচাররা বসেন, আমরা এখন যে ঘরটায় দাঁড়িয়ে। ছোটকা বসেনি। ঘুরে ঘুরে দেখছে। উদ্দেশ্যটা আমি জানি। তবে যার জন্য ঘোরা, সেটা চেয়ারে বসেই দেখা যাচ্ছিল। ছোটকা সেদিকে গেলই না। পাশের ঘরটায় যাবার একটা দরজা ভিতর দিয়েই ছিল। সেই ঘরে ঢুকে এল ও। সারা ঘরে কত রকম প্রাণীর দেহাংশ, ফরমালডিহাইডে চোবানো। একজন ল্যাব-অ্যাটেনডেন্ট আমাদের সঙ্গেই ঘুরছিলেন, নাম বললেন দিবাকর। ডিপার্টমেন্টের এক কোণেই চায়ের বন্দোবস্ত আছে। আরেকজন সেখানে ইতিমধ্যেই চা চাপিয়ে দিয়েছেন। ঘুরতে ঘুরতেই ছোটকা টুকটাক প্রশ্ন করছিল।

দুটো ঘর প্রায় পুরোটা দেখে ও স্কেলেটনটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আমার গা শিরশির করছিল। “বাব্বা, হিউম্যান স্কেলেটনও কাজে লাগে!” ছোটকা নকল বিস্ময় প্রকাশ করল। দিবাকর জবাব দিল, “এতদিন ছিল না। পুজোর পরেই এসেছে।” ছোটকা দাঁড়াল। দেখল। তারপর চেয়ারে গিয়ে বসল। সুবীরকাকু চলে এল। “চল তোকে কলেজটা ঘুরিয়ে দেখাই। সময় হবে না আর। প্রিন্সিপালও একবার দেখা করে যেতে বললেন।” কথাগুলো একটু উঁচু গলাতেই বলল কাকু। উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার। চা খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

বিশাল এলাকা জুড়ে কলেজ। সবটা দেখার আগ্রহ ছোটকার ছিল না। কিন্তু অসিতবাবুর ডিপার্টমেন্টটা শুধু দেখতে গেলে সন্দেহ বাড়বে। সুবীরকাকু তাই সবটাই বুড়ি ছোঁয়া করছিল। দু’-চার জনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। অসিতবাবুর ডিপার্টমেন্টটা দেখলাম। এক কোণে। নির্জনে। এখানেই কেউ খুন করে ফেলে রেখে দিলে সহজে জানাজানি হত না।

কলেজ ঘুরে আমরা প্রিন্সিপালের ঘরে ঢুকলাম। সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে আহ্বান করলেন। ঘরে ঢুকতেই যেদিকে চোখ পড়ল সেটা একটা পেল্লাই মনিটর। মনিটরের পর্দার ছোট ছোট ঘরে কলেজের টুকরো টুকরো ছবি ভেসে উঠছে। পুরো কলেজটাই যে সিসিটিভি-তে মোড়া সেটা আগেই লক্ষ করেছি।

ছোটকা বসার পর সৌজন্য বিনিময় হল, চা জলখাবারের অর্ডার হল। তারপর ছোটকা বলল, “বিশাল কলেজ দেখলাম, অসাধারণ ক্যাম্পাস।” ভদ্রলোকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, “তাও কতটাই বা সময় পেয়েছি বলুন, বছর দশেক। কী ছিল কলেজটা! আমি যখন আসি সুবীরবাবুরা তখন টিনের চালা-ঘরে ক্লাস নিতেন, কুকুর-ছাগল ক্লাসে ঢুকে বসে থাকত।”

সুবীরকাকু দেখলাম সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে প্রিন্সিপাল স্যর বললেন, “ঘাড় না নেড়ে আর কী করবে সুবীর, সত্যিটা তো আর অস্বীকার করা যায় না। এটা আমার জায়গা। এখানে আমার জন্ম-কম্ম। যে ক’দিন আছি, কলেজটাকে আরও বড় করে যাব, সে তোমরা যতই বাধা দাও।”

ভদ্রলোকের গলায় ভূমিপুত্রের অহংকার। কিন্তু হাসি মুখে এমন মসৃণ মোলায়েম ভঙ্গিতে বলছেন, তর্ক করার কোন‌ও জায়গা নেই। ছোটকা কথা ঘোরাল, “আপনার একজন টিচার শুনলাম মিসিং।”

“কে বলল, আপনার বন্ধুটি তো? কী করব বলুন, সাধে কি আর সুবীররা আমাকে অপয়া বলে! আমি জয়েন করার পর চারটে অকালমৃত্যু, তিনটে সুইসাইড। এখন আবার এই মিসিং এপিসোড…”

   হাসি মুখে বলতে বলতেই গম্ভীর হয়ে গেলেন ভদ্রলোক, “ভেরি আনফরচুনেট ইভেন্ট প্রফেসর সেন। আমরা সবাই খুব আপসেট হয়ে পড়েছি। আমার সঙ্গে অসিতের একটা অম্লমধুর সম্পর্ক ছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা প্রফেশনাল জায়গা থেকে। পার্সোনাল লাইফে ও আমার খুব কাছের ছেলে ছিল, ভাইয়ের মতো। ইন ফ্যাক্ট, আমার মিসেস তো খুব ডিপ্রেসড হয়ে পড়েছেন। অসিত আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ডের মতো ছিল। ওরকম ওয়াইজ, অনেস্ট ফ্রেন্ড পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার প্রফেসর সেন। তাছাড়া আপনি জানবেন, সারা পশ্চিমবঙ্গ এই কলেজকে চেনে অসিতের কারণে। ‘অসিত বসু আপনার কলেজেই আছেন তো?’ এই প্রশ্ন আমাকে অনেকেই করে। আফটার অল, ওর লেখক হিসেবে খ্যাতি তো কেউ অস্বীকার করতে পারে না।”

    চেয়ারটা পিছন দিকে হেলিয়ে দিয়ে, হাত দুটো জড়ো করে মাথার পিছনে নিয়ে গেলেন সুভদ্র দফাদার, রামনগর কলেজের দোর্দণ্ডপ্রতাপ অধ্যক্ষ। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

 “পুলিশ কী বলছে?” ছোটকা প্রশ্ন করল‌। প্রশ্নটা শুনে চেয়ার আবার সোজা হল। “কী আর বলবে? যেমন বলে, ইনভেস্টিগেশন চলছে। ওদের বিশ্বাস, ইন ফ্যাক্ট আপনার বন্ধুদের‌ও বিশ্বাস এর পিছনে আমাদেরই এক প্রাক্তন সহকর্মীর হাত আছে।”

“প্রাক্তন সহকর্মী বলতে?”

“ভদ্রলোক অন্য কলেজে চলে গেছেন। তবে ঘটনার দিন উনি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। বকেয়া পাওনাগণ্ডা আর কী। কিন্তু তাতে কী? উনি কি আর অসিতকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যাবেন? যত্তসব।”

“ভদ্রলোকের নাম?”

“প্রকাশ রায়।”

 চেয়ার আবার পিছনে হেলে গেল। হাত মাথার পিছনে। অর্থাৎ ভদ্রলোকের এটি পছন্দের পসচার। কিছু ভাবছেন। চুপ ছোটকাও। ভাবছে। আচমকাই চেয়ার সোজা হল। 

“আচ্ছা প্রফেসর সেন, আপনি তো শুনেছি প্রাইভেটলি টুকটাক ইনভেস্টিগেশন করেন। বেশ সাকসেসফুল‌ও। পুলিশ যা করছে করুক, আপনি একটু নেড়ে ঘেঁটে দেখতে পারেন না?”

  “যাব্বাবা, এটা কী হল!” আমার বিস্ময়ের মধ্যেই দেখলাম, ছোটকা ঘাড় নাড়ছে, “না না। ও একেবারেই শখের ব্যাপার। তাছাড়া আমার কলেজ থাকে। কলকাতার মধ্যে কিছু হলে চাকরি বাঁচিয়ে একটু-আধটু চেষ্টা করি আর কী।”

 সুভদ্র দফাদারের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠছে, “প্রফেসর সেন, টাকাকড়ি হয়তো আপনাকে আমি কিছু দিতে পারব না। আপনি জানেন, কলেজ ফান্ড থেকে সেটা দেওয়াও সম্ভব নয়। তবে আপনি যদি উইক এন্ডের সঙ্গে দু’-একদিন জড়ো করে ইনভেস্টিগেশন করতে রাজি হন, তাহলে কলেজের গেস্ট হাউসে আপনার থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্তটা করা যায়।”

   মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে ছোটকার‌ও। “স্যর, আপনার হয়তো জানা নেই, টাকাপয়সার কথা ভেবে এসব কাজ আমি করি না। এটা আমার শখ। তবে হ্যাঁ, টাকাপয়সা আমি নিই। কিন্তু ওটা না থাকলে আমি কাজ নেব না এটাও যেমন ঠিক নয়, ওটা পকেট ভর্তি করে দিলেই কাজ নেব এটাও নয়। এই কাজটা করতে পারলে আমার ভাল লাগত। আফটার অল, সুবীর খুব আপসেট হয়ে পড়েছে। কিন্তু এটা করা প্র্যাকটিক্যালি একটু ডিফিকাল্ট। তাছাড়া পুলিশ তো দেখছে। ওরা দেখুক না। আমি না হয় ওপর মহলে একটু বলে রাখব। আমাদের পুলিশ কিন্তু খারাপ নয়। ইচ্ছে করলে ওরা সব পারে। পলিটিক্যাল প্রেসার বা ইন্টারফিয়ারেন্সটা না থাকলে কিন্তু…”

   ছোটকা গম্ভীরমুখে চুপ করে গেল। আমি জানি ও কেন বাক্য সম্পূর্ণ করল না। ভদ্রলোকের পলিটিক্যাল পাওয়ারের কথা সুবীরকাকু আমাদের আগেই বলেছে। অবশ্য না বললেও আজ পশ্চিমবঙ্গে এটা সবাই জানে। প্রিন্সিপাল, ভিসি—এগুলো এখন সব পলিটিক্যাল চেয়ার। পেটে বিদ্যে বুদ্ধি বিশেষ না থাকলেও চলে।

  প্রিন্সিপালের চেয়ার আবার পিছনে হেলল। “বেশ। আপনাকে তো আর আমি জোর করতে পারি না। খবর তো আপনি সুবীরের কাছে পাবেন‌ই। যদি আপনার মনে হয়… ইউ আর অলওয়েজ ওয়েলকাম প্রফেসর সেন।”

একটি রহস্যময় মৃত্যু

এক

ভুল করে নয়, আজ ইচ্ছে করেই কবরখানার দিকের গলির পথটা ধরেছিল বিশ্বনাথ৷ অন্যান্য দিন তাকে ভাবতে হয় না, আপনা হতেই তাঁর সুকটারের হ্যান্ডেল বাঁ দিকের চিরচেনা পথের দিকে ঘুরে যায়৷ আজ সম্ভবত অনিল মোহান্তর গল্পটা অবচেতনে একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে৷

বিশ্বনাথের অফিসে অনিল চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী৷ কিন্তু তাকে দেখে কেউ ভাবতেই পারবে না সে আসলে ফোর্থ গ্রেড৷ তাঁর চকচকে জুতো, ঝকঝকে শার্টপ্যান্ট দেখে মনে হওয়া অসম্ভব যে, অনিল মোহান্ত অফিসে ফাইল চালাচালি করে৷ টেবিলে টেবিলে ফ্রেশ জল ভরে রাখে৷ এছাড়াও অফিসে কেউ বিপদে পড়লে চড়া সুদে টাকা ধার দেয়৷ অফিসের ক্যান্টিন বকলমে তাঁর৷ ফাইল চালাচালি করেও বিলক্ষণ দু’পয়সা তাঁর ঘরে ঢোকে৷

বড়ো এল ইডি টিভি কেনার সময়ও বিশ্বনাথের কাছে পরামর্শ চেয়েছিল অনিল৷ পনেরো দিন বাদেই দামি বাইক কিনবে বলে আবার বিশ্বনাথের কাছে সুলুক নিতে এসেছিল৷ কলকবজার ব্যাপারে অফিসে ওভারশিয়ার, আজকাল অবশ্য জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার বলা হয়— বিশ্বনাথ সেনই শেষ কথা৷ তাকেই ধরেছিল অনিল মোহান্ত৷ আরও কারণ আছে৷ অনিলের অলৌকিক ঘটনার সব গল্প শুনে অফিসের সবাই যখন খ্যা-খ্যা করে হাসে, বিশ্বনাথ তখন সিরিয়াস মুখে সেই গল্প শোনে৷ মাঝে মাঝে দু’একটা কথা জিজ্ঞেসও করে৷ ফলে বিশ্বনাথ সেনের ওপর অনিলের অগাধ বিশ্বাস৷ অফিসে এই একটি মানুষেরই যা জ্ঞানগম্যি আছে, আর সব তো ভুসিমাল৷ অসময়েও অনিল তাকে এক কাপ ভালো চা খাওয়ায়৷

—আছে স্যার, আছে৷ একটা সুপার পাওয়ার তো ঠিকই আছে৷ আপনারা সব কিছুর পেছনে আমেরিকার হাত দেখতে পান৷ তাহলে বলুন, যে পবন পাল নিচু একটা আমগাছে চড়তেও ভয় পায়, মই-এর একধাপ উঠেই বলে— মাথা ঘুরছে, সে কী করে  তেঁতুলগাছের মগডালে চড়ে সুইসাইড দিল! বোঝাই যাচ্ছে এখানে বাইরের কোনও পাওয়ার কাজ করেছে৷ সেই পাওয়ারই ওকে ঠেলে ওপরে তুলে দিয়েছে৷ তারপর ধরুন তুরস্কের কথা, আমি নিজে পড়েছি, সেখানে একটা ঝর্না থেকে কন্টিনিয়াস লালজল  বেরোয় শুধু৷ বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছে পিওর ব্লাড৷

—কোন গ্রুপের? বিশ্বনাথ জানতে চেয়েছিল৷

—এ টু জেড, প্লাস-মাইনাস— কিছু মেলেনি৷ এসব বাইরের ব্যাপার৷ আপনি সাইন্সের লোক, কিছুটা আইডিয়া করতে পারবেন৷

বিশ্বনাথ নিজেও দোলাচলে ভোগে৷ সত্যিই কি এই লৌকিক জগতের বাইরে অদৃশ্য কোনও অলৌকিক শক্তি আছে! মানুষের ভাগ্য কি কিছু পাথর আর কোটি কোটি মাইল দূরের গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ন্ত্রণ করে! এসব সে বিশ্বাস করে ছোটোবেলা থেকে৷ তার স্বভাব সব কিছুর কারণ খঁুজে বের করা৷ তার বাবা-মা তার মুখ থেকে ‘কেন, কেন’ শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে রেগে যেতেন৷ ছোটোবেলায় সে দেখেছে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে দুপুর পড়ে এলে বাতাসে একটা ঘূর্ণি ওঠে৷ ধুলোবালি, প্লাস্টিক, ছেঁড়া কাগজ, শুকনো পাতা নিয়ে গরম বাতাসটা ঘুরপাক খায়৷ ঘূর্ণি বাতাসের সঙ্গে সেগুলোও শূন্যে উড়ে যায়৷ সবাই বলত অমঙ্গলের বাতাস৷ অথচ তার ইচ্ছে করত ঘূর্ণির কেন্দ্রে গিয়ে দাঁড়াতে৷ দেখি না কী হয়! বাবা তো বলেছে গরম বাতাস হালকা হয়ে ওপরে উঠে যায়৷ তারপর, কৌটোর ঢাকনা এত টাইট যে, নখ দিয়ে কিছুতেই খোলা যাচ্ছে না, অথচ একটা চামচের মাথা দিয়ে একটা বাচ্চাও খুলে দেবে৷ কেন বাবা? বাবা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন৷ সবাই জানে গ্রহণের সময় খেতে নেই৷ কেন বাবা? বাবা ছবি এঁকে গ্রহণ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন৷ দেখি না কী হয় ভেবে একবার ফিনাইল খেয়ে মরমর হয়েছিল৷ তবু তার সব কিছুর কারণ জানা চাই৷ কেন আর কীভাবে— এর উত্তর না-পাওয়া পর্যন্ত তার তীব্র অস্বস্তি দূর হত না৷

অথচ অনিল মোহান্তর গল্প শুনতে তার ভালো লাগে৷ অনিল বলেছিল তাদের নতুন আবাসনের ওদিকে কোনও কোনও রাতে মাটির নীচে গুম গুম শব্দ হয়৷ ঘরবাড়ি সামান্য কাঁপে৷ আলমারির সঙ্গে ঝোলানো চাবি দুলতে থাকে৷ অথচ অনিল টিভি বা খবরের কাগজে কোথাও ভূমিকম্পের খবর পায়নি৷

—জানেন স্যার আমাদের ওদিকে আগে সব ভেড়ি ছিল৷ বড়ো বড়ো দিঘি ছিল অনেকের৷ ‘নব উন্মেষ’ শহর তৈরির সময় বুজিয়ে দিল৷ দিঘির সব মাছ কি আর জেলেরা ধরতে পারে! সব দিঘিতেই একটা-দুটো বিশাল সাইজের মাছ থাকে৷ জলের অনেক গভীরে ওদের বাসা৷ বড়ো বড়ো সুড়ঙ্গের মধ্যে থাকে৷ কোনও কোনও জ্যোৎস্না রাতে সেই মাছগুলো জলের ওপরে উঠে আসে৷ কখনও ভারী বজরার চালে, কখনও পানসির মতো সাঁই সাঁই সাঁতার কাটে৷ আর সে কী শব্দ! পুরনো লোকজন বলে তখন দিঘির দিকে তাকাতে নেই৷ অবতারের লীলাখেলা মানুষের দেখতে নেই৷ চোখ অন্ধ হয়ে যায়৷ যারা সাহস করে দেখতে গেছে, সবার চোখ অন্ধ হয়ে গেছে৷

—তাই আবার হয় নাকি? আসলে এটা ওদের মেটিং৷ নইলে দিঘিতে নতুন মাছ আসবে কোথা থেকে?

—একই কথা স্যার, আপনারা বলেন মেটিং, আমরা গ্রামের লোকজন বলি লীলাখেলা৷ ব্যাপার একই স্যার৷ আমাদের ওদিকে মাটি এখনও সস্তা৷ মানে আমাদের গ্রামের বাড়ির কথা বলছি৷ পারলে কিছুটা মাটি ধরে রাখুন৷ আখেরে কাজে দেবে৷ মাটিই হল খাঁটি৷

বিশ্বনাথ শুনেছিল অনিল মোহান্ত জমির দালালিও করে৷ যেখানে সামান্য পয়সার গন্ধ, সেখানেই পিঁপড়ের মতো লেগে থাকে৷ মহাজনি কারবার, জমির দালালি, ক্যান্টিন, অফিসে ঠিকাদারদের সঙ্গে ওঠাবসা— পয়সার ব্যাপারে তার ন্যায়নীতি, বিবেকবোধ কাজ করে না৷ কিন্তু অলৌকিক তত্ত্বে তার গভীর আস্থা৷ আর, এসব লোকের যেমন হয়— অবচেতন মনে পাপের ভয় থেকে হাতভর্তি পাথর৷ চন্দ্র, সূর্যসহ সব গ্রহ-নক্ষত্রকে কব্জা করে ফেলেছে৷ এদিকে তার অসুখ-বিসুখে কিছুতেই ডাক্তার দেখাবে না৷ অ্যালোপ্যাথি ওষুধ নাকি সব বিষ৷ তার শরীরে সহ্য হয় না৷ দেশীয় পদ্ধতিতে এ গাছের শিকড়, ও-গাছের বাকল, সে-গাছের পাতা— এই করে চালায়৷ আসল কথাও একদিন বলে ফেলেছিল৷ তার নাকি ইঞ্জেকশনে বড়ো ভয়৷ আজ পর্যন্ত শরীরে সূচ ফোঁটায়নি৷

—তার মানে ছোটোবেলাতেও তুমি কোনও ভ্যাকসিন নাওনি? হেপাটাইটিস্, ধনুষ্টঙ্কার, জলাতঙ্ক, পোলিও… ওরাল ড্রপও নাওনি?

ওসব স্যার আমাদের লাগে না৷ আমরা সবাই হাটেমাঠে ঘুরে বেড়ানো সামান্য মানুষ৷ নেহাত ঘোষবাবু ফিতে ধরাটা শিখিয়েছেন, সিএফটির হিসেব শিখিয়েছেন, ঠিকাদারগুলোও ভালো ছেলে, তাই কোনও রকমে দিন চলে যায়৷ তো আমার ধারণা স্যার একদিন নব উন্মেষ টাউনশিপের মাটির তলা থেকে ওই রাক্ষুসে মাছগুলো এমন ঘাই দেবে, ইট-সিমেন্ট লোহার খাঁচাগুলো সব ভেঙে পড়বে৷ ওইজন্য আমি গ্রামের বাড়িতেই বেশির ভাগ সময় থাকি৷ আমার মনে হয় মাছগুলো সব মিটিং করছে৷ তলে তলে তো সব জলে কানেকশন আছে! একদিন ঠিক প্রতিশোধ নেবে ওরা৷

—দেখো অনিল, উন্নয়ন হলে উচ্ছেদ হবেই৷ তুমি কোনটা চাও, আর কোনটা চাও না? ভালো কথা, তুমি তো গ্রামের বাড়িতে থাকো, তোমার ফ্যামিলি কোথায় থাকে?

—ওদের নব উন্মেষের ফ্ল্যাটে রেখেছি৷ সাততলার ওপর রোদে হাওয়ায় ভালোই আছে৷ স্যার একদিন আমার গ্রামের বাড়িতে আসুন৷ কয়েকটা প্লট দেখাব আপনাকে৷

দুই

ফাইন্যালি বিশ্বনাথ সিদ্ধান্ত নিল অনিলের সঙ্গে জমি দেখতে যাবে৷ আসলে অনিলের ওপর তার অদ্ভুত একটা আকর্ষণ তৈরি হচ্ছিল৷ অনেকটা ‘আপনাকে তো কালচার করে দেখতে হচ্ছে মশাই’ ভঙ্গিতে সে স্থির করল অফিসে নয়, তার সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে সময় কাটাবে জমি দেখার অছিলায়৷ অনিল মোহান্ত বড়ো ইন্টারেসটিং ক্যারেক্টার৷

অনিলের বিষয়ে একটু প্রাথমিক খোঁজখবর নেওয়া দরকার৷ ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্ট নিরাপদ নস্করকে টিফিন আওয়ারে বাইরের দোকানে নিয়ে গেল বিশ্বনাথ৷ দুজনের জন্য চা আর টোস্ট ওমলেটের অর্ডার দিল৷ নিরাপদ ঘাঘু মাল৷ বুঝতে দেরি হয়নি ওভারশিয়ারবাবুর কিছু প্রাইভেট কথা আছে৷ এই বিশ্বনাথ সেন লোকটা বড়ো আশ্চর্যের জিনিস৷ উপরি পয়সার কথা তার কাছে বলার সাহস কোনও ঠিকাদারের নেই৷ এক্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার পর্যন্ত সম্মান দিয়ে কথা বলে৷ লোকটার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে কথা বলতে অস্বস্তি হয়৷ বেঁচে থাকতে গেলে একটু-আধটু পাপ করতেই হয়৷  আর ওভারশিয়ারবাবুর চোখ যেন মনের ভেতরটা স্পষ্ট পড়ে নিতে পারে৷ অফিসে কম কথা বলে৷ ইদানীং দেখা যাচ্ছে অনিলের সঙ্গে ফিসফাস কী সব কথা হচ্ছে৷ সম্ভবত অনিল সস্তায় জমির টোপ দিচ্ছে৷ সুযোগ পেলে অনিল সম্পর্কে সাবধান করে দিতে হবে৷ লোকটা পয়সাকড়ির ব্যাপারে যেমন চামার, তেমনই নিষ্ঠুর৷

—নিরাপদ, তোমার কাছে একটা পরামর্শ চাই৷ তুমি তো অফিসের পুরনো স্টাফ, লোকাল লোক৷ অনিল মোহান্ত কেমন লোক?

—স্যার, একটা সিগারেট খাই? অফিসের ভেতরে তো মহিলারা আন্দোলন করে সিগারেট বন্ধ করে দিয়েছে৷ বারে বারে বাইরে গিয়ে টানতে হয়৷

—খাও, আমার ওসব প্রেজুডিস নেই৷ অনিল মোহান্তর কথা বলো৷

—আপনাকে নিশ্চয়ই জমির কথা বলে ভুজংভাজুং দিচ্ছে৷ অফিসের অনেককেই জমি গছিয়েছে৷ তারপর দেখবেন আপনাকে একটা জঙ্গলের পথ দিয়ে ওর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবে৷ যাওয়ার পথে একটা কবরখানা আছে৷ সেটা নিয়ে একটা গল্প ফাঁদবে৷ দেখবেন সত্যিই সেখানে একটা ভাঙাচোরা ঘরে একজন বিধবা মহিলা থাকে৷ অনিল একটা পাষণ্ড৷ ওই বিধবার জমি, বাড়ি সব সরকার দখল করে নেবে ভয় দেখিয়ে, ফলস্ নথিপত্র দেখিয়ে জলের দামে কিনে নিয়েছে৷ এরকম অনেক কেস করেছে৷ লোকটা জমির গন্ধ পায়৷ মানুষের লোভের, মানুষের অসহায়তার গন্ধ ঠিক বুঝতে পারে৷ টাকার থলি নিয়ে তাকে পৈতৃক ভিটে থেকে উৎখাত করে সেখানে ফ্ল্যাট তোলে৷ আর, সবাইকে আজগুবি গল্প শুনিয়ে ভজিয়ে রাখে৷ দেখবেন, ওর কাঁধে সবসময় একটা সাইডব্যাগ থাকে৷ সেখানে দুনিয়ার লোকের জমির দলিল, পাট্টার কাগজ, নামজারি, স্ট্যাম্পপেপার৷ কেমন চালাক জানেন, যে-জমির ওপর ওর দৃষ্টি পড়বে শকুনের মতো তার ওপর পাক খেতে থাকে৷ আস্তে আস্তে বৃত্তটা ছোটো করে আনে, তারপর সাঁ করে জমিবাড়ি ঠোঁটে তুলে নেয়৷

প্রথম দিন অনিলের সঙ্গে বিশ্বনাথ জমি দেখতে গিয়েছিল৷ বিশ্বনাথের পুরনো সুকটার, অনিলের ঝাঁ-চকচকে নতুন বাইক৷ শহর থেকে এত দূরে জমি কেনার আসলে কোনও ইচ্ছে ছিল না বিশ্বনাথের৷ শুধু অনিলের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলা যাবে, এই ভেবে রাজি হয়েছিল৷ ক্রমশ সে অনিলগ্রস্ত হয়ে পড়ছিল৷ লোকটার ভেতরটা পরিষ্কার দেখতে না-পাওয়া পর্যন্ত তার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল৷ দেখি না কী হয়— এই ভাবনায় সে রওনা হয়েছিল৷

একটা জায়গায় এসে পথটা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে৷ বাঁ দিকের পথটা বিশ্বনাথ চেনে৷ নতুন শহরের দিকে চলে গেছে৷ সেখানে দশতলা, পনেরোতলা ঘরবাড়ি খুব দ্রুত আকাশ ঢেকে দিচ্ছে৷ ডানদিকের পথটা সরু৷ কিছুটা গিয়ে বড়ো বড়ো গাছের আড়ালে মিলিয়ে গেছে৷ কিছুক্ষণ পাশাপাশি যাওয়ার পর মোড়ের মাথায় আসতেই অনিল এগিয়ে গেল৷ ডানদিকের ইন্ডিকেটর জ্বালিয়ে, হাতও দেখিয়ে বুঝিয়ে দিল পথটা ছেড়ে এবার ডানদিকের সরু পথটা ধরতে হবে৷

এ-পথে বিশ্বনাথ কোনও দিন আসেনি৷ পথের দু’পাশে বিশাল সাইজের প্রাচীন শিরীষ গাছ৷ সেগুলোর ডালপালা অর্ধবৃত্তাকারে ঝুঁকে পড়েছে৷ দূর থেকে দেখে মনে হয় অনন্ত তোরণ বুঝি৷ ছায়াঢাকা, ঠাণ্ডা পথ৷ একটু দূরে মাঠের মাঝে ডোবা, বাঁশঝাড়, আমকাঁঠাল, নারকেল-সুপারির জমাট সংঘ৷ পুরো জায়গাটা অসম্ভব নির্জন৷ আর কোথাও কোনও শব্দ নেই৷ এতক্ষণেও পথে আর কারও সঙ্গে দেখা হয়নি, একটা পাখির ডাকও শোনেনি ওরা৷ এই অসম্ভব নির্জনতা, নৈঃশব্দ্য আর দূরের জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া পথ— সব মিলে স্তব্ধতার একটা পাষাণভার বিশ্বনাথের বুকে ক্রমশ চেপে বসে ছিল৷ অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি টের পাচ্ছিল বিশ্বনাথ৷ কোনও সাংসারিক শব্দ শোনার জন্য ভীষণ আকুল হয়ে উঠেছিল৷ মনে হচ্ছিল কোনও নিষ্প্রাণ জগতের ভেতর দিয়ে অনন্তকাল ধরে তাদের এই রহস্যময় যাত্রা৷

—স্যার, একটু বাদেই ডানদিকে কবরখান৷ খ্রিস্টানপাড়ার লোকজন এখানেই গোর দেয়৷ পাথরে সব লেখা আছে৷ মাইকেল গোরাচাঁদ মল্লিক, আব্রাহাম নস্কর৷ চলুন স্যার, একটা জিনিস দেখাব৷

অনিল মোহান্ত তার নতুন বাইক বিশ্বনাথের সুকটারের পাশে এনে ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে ফিসফিস করে বলল৷ বিশ্বনাথের কেমন যেন ঘোর লেগে যাচ্ছিল৷ বুঝতে পারছিল পরিবেশের জন্য এরকম মনে হচ্ছে৷ অনিল মোহান্ত যখন তার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল— একটা জিনিস দেখাব, তখন শরীরটা শিরশির করে উঠেছিল বিশ্বনাথের৷

—কী জিনিস? বিশ্বনাথ জানতে চেয়েছিল৷ অলৌকিক কোনও দৃশ্য দেখাবে নাকি অনিল৷ খুব কৌতূহল হচ্ছিল তার৷

—একজন বৃদ্ধ মহিলা,  বিধবা— আপনার কপালে হাত বুলিয়ে আপনার ভূত- ভবিষ্যত-বর্তমান, সব হুবহু বলে দেবে৷ শহর থেকে কত মানুষ আসে তার কাছে৷

—না অনিল, ভাগ্যগণনা আমি একদম বিশ্বাস করি না৷ ফালতু সময় নষ্ট করে লাভ নেই৷ চল তোমার জমি দেখে আসি৷ এই নির্জনে একজন একা মহিলা কীভাবে থাকে বলো তো? কবরখানার পাশে একা একা, ভয়ডর নেই?

—সত্যি কথা বলতে কী স্যার, অসহায় বিধবা, আমিই এখানে ওর মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করে দিয়েছি৷ আমি আবার মানুষের দুঃখকষ্ট সহ্য করতে পারি না৷ একা কেন হবে, ওর একটা সুন্দরী বোন আছে তো! ওরা দুজনে মিলে থাকে৷ বোনটা আমার বাড়িতে কাজকর্ম করে৷ যা টাকা দিই, ওদের দুজনের বেশ ভালো চলে যায়৷ একটা বাড়ি ছিল অনেকটা জমি নিয়ে৷ বিধবা বুড়ি, সঙ্গে বোন৷ বাড়িটা সারানোর ক্ষমতাও আর ছিল না৷ বড়ো আতান্তরে পড়ে ছিল৷ আমাকেই এগিয়ে আসতে হল৷ এখানে ঘর তুলে দিলাম৷ বোনটাকে আমার বাড়িতে বহাল করলাম৷

—বাড়িটা?

—বাড়ি-জমির ওপর অনেকের নজর পড়েছিল৷ রাখতে পারত না৷ বলছি বটে বুড়ি, আসলে অতটা নয়৷ খারাপ লোকজন নজর দিতে শুরু করেছিল৷ আমিই আগলে আগলে রেখেছি৷ এখানে মাঝে মাঝে আসি৷ খোঁজখবর নিই৷ বেচারা!

—রাতে দু’জন থাকে, কত রকম বিপদ-আপদ  হতে পারে…

—সে-কথাই তো আপনাকে বলতে চাইছি৷ আপনারা তো কিছু বিশ্বাস করেন না৷ রাতে কবরখানার ওদিক থেকে একটা বিশাল বড়ো কুকুর এসে ওদের দরজার পাশে শুয়ে থাকে৷ ভয়ংকর হিংস্র দৃষ্টি৷ একজন খারাপ মতলব নিয়ে একরাতে ওদের দরজায় টোকা দিয়েছে৷ কোথা থেকে আচমকা এসে বাঘের মতো লাফিয়ে তার টুঁটি কামড়ে ধরেছে৷ তাকে নাকি টানতে টানতে কবরখানার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল৷ চোখদুটো নাকি বাঘের মতো জ্বলছিল৷ যেন আগুনের ভাঁটা৷ কুকুরের ডাক শুনে আর ধস্তাধস্তির আওয়াজ পেয়ে দু’বোন বাইরে এসে দেখে রঞ্জন বৈদ্যর খুব খারাপ অবস্থা৷ ওরা অনেক কষ্টে কুকুরটাকে ছাড়িয়েছে৷ নইলে রঞ্জনের হাড়মাংস চিবিয়ে খেত কুকুরটা৷ কী বলব স্যার, কুকুরটাকে দেখলেই বুকের রক্ত জল হয়ে আসে৷ কুচকুচে কালো, গায়ে বড়ো বড়ো ঝালরের মতো লোম৷ কুকুরটা মনে হয় দু’নম্বরি কাজের গন্ধ পায়৷ ওকে আমার বড়ো ভয় করে৷

—হুম, বউটার স্বামী কীভাবে মারা গিয়েছিল?

—তারও স্বভাবচরিত্র ভালো ছিল না৷ এই দশাসই চেহারা, ঘোর কালো গায়ের রং৷ ভীষণ বদরাগী ছিল রঘু মণ্ডল৷ কথায় কথায় মারামারি, ছুরি চালাতে হাত কাঁপত না৷ জেলও খেটেছে ক’বার৷ শেষে একদিন এই কবরখানার জঙ্গলেই তাকে পাওয়া গেল৷ সম্ভবত কেউ মার্ডার করে এখানে ফেলে রেখেছিল৷ সারারাত শেয়াল-কুকুরে তার নাড়িভুঁড়ি খুবলে খেয়েছে৷ বীভৎস দৃশ্য, দেখা যায় না৷ আচ্ছা স্যার, একটা সন্দেহ আমাকে দীর্ঘদিন কুরে কুরে খাচ্ছে৷ স্যার, মানুষের আত্মা কি কুকুরের শরীরে যেতে পারে?

—না অনিল, এরকম হয় না৷ এসব তোমার বাজে সন্দেহ৷ অলৌকিক গল্প শুনতে শুনতে, আর শোনাতে শোনাতে সব অস্বাভাবিক ঘটনার পেছনেই তোমার মনে হয় এর পেছনে কিছু অলৌকিক ব্যাপার আছে৷ মানুষের আত্মা কুকুরের শরীরে কী করে ঢুকবে? সব কিছুর পেছনেই রহস্যজনক কিছু ভাবতে তোমার ভালো লাগে৷

—স্যার, বিজ্ঞান কি পৃথিবীর সব রহস্যের সমাধান করে ফেলেছে?

—না, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য অনন্ত৷ বিজ্ঞান তার সামান্যই জানতে পেরেছে৷ কিন্তু যতটুকু জেনেছে, যুক্তিপ্রমাণ দিয়েই জেনেছে৷

—তবে স্যার, আপনাকে বলে রাখছি, সুযোগ পেলে কুকুরটাকে আমি মেরে ফেলব৷ হয় মাংসের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে, অথবা বাইক চাপা দিয়ে৷ আমাকে দেখলেই ওর চোখদুটো ধক্ করে জ্বলে ওঠে৷ ওর তাকানো আমি সহ্য করতে পারি না৷ ওকে মেরে না ফেলা অব্দি আমার স্বস্তি নেই৷

এক মুহূর্তের জন্য বিশ্বনাথের চোখের মণিদুটো ধক্ করে জ্বলে উঠল৷ তার বাড়ির নিজের কুকুরগুলোর কথা মনে পড়ল৷ তার প্রিয় কুকুর টাইগারও বিশাল বড়ো, কালো রং৷ নানারকম কুকুর পোষা তার প্রিয় শখ৷ এছাড়া, রাস্তা থেকে অসুস্থ কুকুর তুলে এনে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলা তার ভালো লাগার বিষয়৷ বিশ্বনাথ প্রাণ দিয়ে তার পোষ্যগুলোকে ভালোবাসে৷ অনিল মোহান্ত কুকুরটাকে মেরে ফেলতে চায়, শুনে তার চোখে মুহূর্তের জন্য আগুন জ্বলে উঠেছিল৷ সেই মুহূর্তে অনিলকে তার একটা ঘৃণ্য জন্তু মনে হচ্ছিল৷ এ লোকটার পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার নেই৷

—এই যে স্যার দেখছেন দু’পাশে ফাঁকা জমি, সব বায়না হয়ে গেছে৷ গোবিন্দপুরের বাজার স্যার পাঁচ মিনিটের হাঁটা  পথ৷ কেমিক্যাল হাব হওয়ার কথা৷ তখন এ মাটি সোনার হয়ে যাবে৷ স্যার, কিছু টাকা না হয় এখানেই ইনভেস্ট করে রাখলেন৷ সময়মতো  ছেড়ে দেবেন৷ অনেক বেশি রিটার্ন পাবেন৷ ওই যে দেখুন, কয়েকজন পিলার তুলে নিজের জমি মার্ক করে রেখেছে৷ এ সুযোগ ছাড়বেন না স্যার৷ এই যে এসে গেছি আমার বাড়িতে৷ চলুন, একটু বসবেন৷

—না অনিল, সন্ধে লেগে গেছে৷ আবার আসব৷ জমিটা ভালো করে দেখে-শুনে নেব৷ ভালো কথা, মাঝে মাঝে তো তুমি বাইক ছাড়াই অফিসে যাও৷ তখন বাইকটা কোথায় রেখে যাও?

—এখানেই রেখে যাই স্যার৷ চুরির ভয় নেই৷ এখানে সবাই আমাকে চেনে৷ আমার গাড়িতে হাত দেবার সাহস কারও হবে না৷ তা ছাড়া, রাত আটটা পর্যন্ত তো মালতীই থাকে৷

বিশ্বনাথ দেখল দরজার আড়াল থেকে একজন মহিলা বড়ো বড়ো চোখে তাকে দেখছে৷ সুন্দর মুখ, কিন্তু চোখদুটোতে ভয় রয়েছে৷ বিশ্বনাথের চোখে চোখ পড়তেই চট করে ভেতরে চলে গেল৷

তিন

বিশ্বনাথের নিজের কুকুর চারটে৷ দুটো ল্যাব্রাডর, একটা কালো অ্যালসেশিয়ান, একটা বড়ো সাইজের টিবেটান ম্যাস্টিফ৷ কুকুর পোষা তার চিরকালের শখ৷ তাদের বাড়িতে কুকুর ছিল না৷ এমন কোনও সময় মনে পড়ে না৷ বাড়ির সবাই কুকুর ভালোবাসে৷ কিন্তু তাদের দেখাশোনা সব বিশ্বনাথের নিজের হাতে৷ সময়মতো বিভিন্ন ইঞ্জেকশন্ দেওয়া, শ্যাম্পু দিয়ে স্নান করানো, অসুস্থ হ’লে ডাক্তার দেখানো— সব বিশ্বনাথের হাতে৷ তবে এই ভালোবাসার প্রাণীগুলোর যখন আয়ু ফুরিয়ে যায়, বড়ো কষ্ট হয় তখন৷  মনে হয়— নাঃ, আর কুকুর পুষব না৷ পনেরো-কুড়ি দিন বাদেই বিশ্বনাথ গিয়ে ভালো ব্রিডের কোনও পাপি নিয়ে আসে৷ কুকুর আর সেতার বাজানো, এ দুটোই তার তীব্র প্যাশন৷

এরা তার বাড়ির পোষা কুকুর৷ আর একটা দল আছে, ওরা বিশ্বনাথের বাড়ির বাইরে গেটের সামনে বসে থাকে৷ সকালে একগাদা রুটি, দুপুরে আর রাতে ভাত ওদের বরাদ্দ৷ বেপাড়ার কোনও কুকুরের সাহস নেই এদিকে আসার৷ এরা দলবদ্ধভাবে তাকে ছিঁড়ে খাবে৷ এরিয়া ভাগ করা থাকে তোলাবাজদের মতো৷ যার যার এরিয়ায় সে সে বাদশা৷ রীতিমতো হারেম বানিয়ে এক-একটা এরিয়ার দখল নিয়ে নেয়৷ সি কে ব্লকে মোড়ের মাথায় বিশ্বনাথের বাড়ি৷ মা আর এক ভাইকে নিয়ে তার সংসার৷ আর আছে সব সময়ের কাজের মেয়ে মুন্নি৷ মুন্নির হাতেই সংসারের সব দায়িত্ব৷

বাইরের কুকুরগুলোকে নিয়ে বিশ্বনাথের অত চিন্তা নেই৷ লড়াই করে বেঁচে থাকা জীবন ওদের৷ পোষা কুকুরদের চেয়ে ওদের জীবনীশক্তি অনেক বেশি৷ তাও কারও ঠ্যাং ভাঙলে, বা মারামারি করে ক্ষত তৈরি হলে বিশ্বনাথ চিকিৎসা করে সারিয়ে তোলে৷ মানুষের সবচেয়ে বিশ্বস্ত এই প্রাণীগুলোর ওপরে অসম্ভব ভালোবাসা বিশ্বনাথের৷ যখন শোনে কোথাও কেউ শুধু শুধু এদের ওপর অত্যাচার করছে, লেজে পটকা বেঁধে নিষ্ঠুর আনন্দ উপভোগ করছে, ইচ্ছে করে গাড়ি চাপা দিয়েছে, বিশ্বনাথের মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে৷ সে নিজেও এম পি সি এ’র সদস্য৷ খুব ঠাণ্ডা মাথার মানুষ বিশ্বনাথ, কিন্তু যখন খবর পায় বৃদ্ধ কুকুরকে কেউ ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে রেখে চলে গেছে, তখন তার মাথা ঠিক রাখতে পারে না৷

আজ টিফিন আওয়ার্সে অনিল মোহান্ত এসেছিল৷ বিশ্বনাথ আবার কবে যাবে, ওদিকে জমির দর হু হু করে বেড়ে চলেছে— এসব কথা বলতে এসেছিল৷ আসলে তাগাদা দিতে এসেছিল৷ তারপর ঘুরেফিরে সেই রহস্যময় গল্প৷ বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা মেলে না৷  বার্মুডা ট্রায়াঙ্গেলের গল্প, অভিশপ্ত আত্মার কাহিনী, সাপের প্রতিহিংসা, বিশ্বনাথ চুপচাপ শোনে৷ অনিল মোহান্তকে আরও একটু চিনতে হবে৷

—বুঝলে অনিল এরপর যেদিন যাব, কবরখানার পাশে ওই মহিলার বাড়ির সামনে একটু দাঁড়াব৷

—কেন স্যার, ভাগ্য গণনা করাবেন?

—না, তোমাকে তো বলেছি ওসব আমি বিশ্বাস করি না৷ তুমি যে কালো কুকুরের কথা বলেছিলে, সেটাকে দেখার আমার খুব কৌতূহল রয়েছে৷

—খবরদার স্যার, সাক্ষাৎ যমদূত৷ ওর চোখের দিকে তাকালে আমার বুকের ভেতরটা ঠাণ্ডা হয়ে আসে৷ কী দরকার!

—ভয় পেয়ো না৷ আমার সব ভ্যাকসিন নেওয়া আছে৷ বরং তোমাকে আঁচড় কামড় দিলে বিপদের ব্যাপার৷ আমার বাড়িতে চারটে কুকুরের দেখাশোনা আমার হাতে৷ প্লাস, রাস্তার কুকুর অসুস্থ হ’লে তার চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলি৷ আমার জন্য তুমি ভেব না৷

—না স্যার, যাবেন না৷ আর গেলেই যে দেখতে পাবেন, এমন কোনও গ্যারান্টি নেই৷ সাধারণত গভীর রাতে বেরিয়ে আসে৷ আপনার কিছু হলে আমি চিরদিনের জন্য দায়ী হয়ে থাকব৷

বিশ্বনাথ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল৷ গভীর, অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল অনিলের চোখের দিকে৷ চোখ সরিয়ে নিল অনিল৷ দেখে মনে হ’ল তার কেমন অস্বস্তি হচ্ছে৷

—আচ্ছা অনিল, যাঁর ওপর সেই কুকুরটা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল— রঞ্জন বৈদ্য, সে কোথায় থাকে বলতো?

—কে, কেন স্যার? কাঁচা আনাজের আড়তদার, সব সময় এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায়৷ বাড়িতে প্রায় থাকেই না৷ আমাকে বলুন স্যার, রঞ্জনের সব খবর আমার জানা৷ খারাপ স্বভাবের  লোক৷ ক্যারেকটার গেলে মানুষের আর কী থাকে বলুন!

—রঞ্জনের বিষয়ে নয়, কুকুরটা নিয়ে আমার কৌতূহল হচ্ছে৷ তোমার গল্প শুনে আমার আর্থার কোনান ডয়েলের ‘হাউন্ড অফ দা বাস্কারভিলস’ গল্পটার কথা মনে পড়ছে৷ ওই রকম তাগড়াই, বিশাল চেহারার কুকুরের জন্য রোজ যে পরিমাণ অ্যানিমেল প্রোটিন দরকার, সেটা কোথা থেকে পায়! ওই বৃদ্ধা আর তার বোনের ক্ষমতা নেই রোজ তাকে মাংস খাওয়ানোর৷ তবে কি কবর থেকে মৃতদেহ তুলে এনে খুবলে খায়? নাঃ, তাহলে তোমরাই খবর পেতে৷

—আমরা কীভাবে খবর পাব স্যার? ওই কুকুরের জন্য ওদিকে যাওয়ার সাহসই নেই কারও৷

—তোমরা যাবে কেন? যারা মৃতদেহ কফিনে করে সমাধি দিতে নিয়ে আসে, তাদের চোখেই পড়ত৷ গ্রেভ ইয়ার্ডে, মানে তোমার কবরখানায় পাহারাদার থাকার কথা৷ সে সবাইকে জানাত৷ এ কী ভৌতিক কোনও কুকুর নাকি! খাদ্য দরকার হয় না!

পরদিন অফিসে এসেই অনিল বিশ্বনাথের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল৷ মুখটা হাসি হাসি৷

—কী ব্যাপার অনিল, কোনও ভালো খবর মনে হচ্ছে?

—সে এক গল্প স্যার, কাল অফিস থেকে বাড়িতে ফিরছি৷ এক পার্টিকে জমি দেখাতে একটু দূরে গিয়েছিলাম৷ ফিরতে বেশ রাত হয়েছিল৷ কবরখানার কাছাকাছি আসতেই বেশ শীত করে উঠল৷ বাইক থামিয়ে ডিকি থেকে উইন্ডচিটার বার করে পরতে গেছি৷ হঠাৎ দেখি দূর থেকে দুটো আগুনের গোলার মতো চোখ আমার দিকে ছুটে আসছে সাক্ষাৎ যমদূতের মতো৷ আর সে কী বীভৎস গর্জন! মনে হচ্ছে আমাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে৷

—তারপর তুমি কী করলে?

—কোনও মতে বাইক স্টার্ট দিয়ে রওনা হয়েছি, নরকের কুকুরটা দেখি আমার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়চ্ছে৷ আমি যত স্পিড বাড়াই, কুকুরও তত জোরে দৌড়য়৷ আমার মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমার ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে৷ কিংবা সাইড থেকে আমার একটা গোটা ঠ্যাং কেটে নিয়ে যাবে৷ তারপর সেটা দিয়ে ভূরিভোজ সারবে৷ নরখাদক শুধু বাঘই হয় না স্যার, কুকুরও হয়৷ দি রয়্যাল বেঙ্গল ডগ৷ পৃথিবীতে যে কত অবিশ্বাস্য ব্যাপার ঘটে, আমরা তার কতটুকু খবর রাখি! এটা স্যার সাক্ষাৎ যমদূত৷ কবরখানার ডেডবডি খেতে খেতে অরুচি ধরে গেছে, এখন টাটকা রক্তমাংস চাইছে৷

—বেশ, তারপর! এ তো ভয়ংকর ব্যাপার! বেঁচে গেছ তুমি৷

—তারপর জানেন, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল৷ কুকুর তখন আমার পাশে পাশে সমান জোরে দৌড়চ্ছে৷ যে কোনও মুহূর্তে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে৷ আমি আচমকা স্পিড কমিয়ে ওকে এগিয়ে যেতে দিলাম৷ তখন আমার গাড়ির হেডলাইট পড়ল ওর মুখে৷ বাপরে, চোখ দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে, সামনের দুটো তীক্ষ্ন দাঁত ঝকঝক করছে৷ পাগলা কুকুরের মতো জিভ দিয়ে লালা ঝরে পড়ছে৷ আমি সাহস হারাইনি৷ যা প্ল্যান করেছিলাম, সেইমতো হঠাৎ আমার বাইকের স্পিড বাড়িয়ে আমার দিকে ছুটে আসা কুকুরটার ওপর সোজা চালিয়ে দিলাম৷ প্রচণ্ড জোরে একটা ধাক্কা লাগল৷ আমি ছিটকে পড়লাম পাশে ঘাসের ওপর৷ ভাগ্যিস হেলমেট ছিল!

—কুকুরটাকে মেরে ফেললে?

—কী করব বলুন? না হ’লে তো আমাকেই মেরে ফেলত৷ তা ছাড়া এই জন্তুটাকে আমি একদম পছন্দ করি না৷ ছেলেবেলায় ওদের লেজে তারাবাজি জ্বালিয়ে বেঁধে দিতাম৷ ও, কী দৌড়ত! ভারী আমোদ হত আমার৷

—আচ্ছা! আশ্চর্য শীতল কণ্ঠে বলল বিশ্বনাথ৷

টিফিন আওয়ার্সে নীচে নেমে বাইক স্ট্যান্ডে গিয়ে অনিল মোহান্তির নতুন বাইক দেখে এল বিশ্বনাথ৷ মনে হ’ল দেখে সন্তুষ্ট হয়েছে৷ তার মুচকি হাসি দেখে সেরকমই মনে হয়৷ মাথাটা পরিষ্কার হয়ে আসছে৷ আজ অনেকক্ষণ রেওয়াজ করবে৷ 

চার

রেওয়াজে বসলে দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে বিশ্বনাথ৷ একটা রিদম অ্যাপ তার মোবাইলে লোড করে নিয়েছে৷ সব রকম তাল বাজানো যায়৷ লয় বাড়ানো-কমানো যায়৷ রোজ তার সঙ্গে কে সঙ্গত করতে আসবে৷ এটা দিয়ে বেশ কাজ চলে যায়৷ আজ প্রথমেই তার মেজাজ বিগড়ে গেল৷ বেশ কিছুদিন বাজানো হয়নি৷ আজ তারগুলো সুরে বাঁধতে গিয়ে পটপট করে ছিঁড়তে লাগল৷ সামান্য মরচে পড়েছিল হয়তো৷

নতুন তার বাঁধতে গিয়ে একটা তারে সরু মাথা অসাবধানে তার তর্জনীর মাথায় ফুটে গেল৷ স্টিলের এই তারগুলো খুব সরু কিন্তু প্রচণ্ড শক্ত হয়৷ তার বাঁধার সময় একটু অসাবধানেই আঙুলের মাথায় খোঁচা লাগে৷ বিশ্বনাথ দেখল তার আঙুলের মাথায় যেন একবিন্দু চুনি ফুটে আছে৷ অন্যমনস্ক ভাবে সেদিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল বিশ্বনাথ৷ তারের সূক্ষ্ম মাথাটা একবার দেখল৷ তুলোয় ডেটল লাগিয়ে আঙুলের মাথায় চেপে ধরে রইল কিছুক্ষণ৷ তারপর ডুবে গেল জয়জয়ন্তীর গভীরে৷

দূর থেকে অস্পষ্ট হৈ-হল্লার আওয়াজ কানে আসছিল বিশ্বনাথের৷ শব্দটা ক্রমেই বাড়ছে৷ মনে হচ্ছে এই রাস্তা ধরেই আসছে৷ অনেক লোকের একসঙ্গে ‘মার মার’ শব্দ কানে যেতেই সেতার রেখে উঠে দাঁড়াল বিশ্বনাথ৷ তাদের বাড়ির দিকেই অনেক লোক  লাঠি, লোহার রড, হকিস্টিক নিয়ে ছুটে আসছে৷ বিশ্বনাথ প্রথমে ভাবল চোর৷ তারপর দেখল একটা কুকুরের পেছনে ওরা তাড়া করে আসছে৷ আর সেই তাড়া-খাওয়া কুকুরটাকে দেখে এই মোড়ের সব কুকুরগুলো দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাচ্ছে৷ আশ্চর্য ব্যাপার, ওরা তো বেপাড়ার কুকুর দেখলে সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ নীচে নেমে গেট খুলে বাইরে এল বিশ্বনাথ৷ সঙ্গে সঙ্গে চার-পাঁচজন চিৎকার করে উঠল— ‘আসবেন না দাদা, পাগলা কুকুর৷ আমাদের পাড়ার তিনজনকে কামড়েছে৷ ওই দেখুন মুখ দিয়ে কেমন লালা পড়ছে৷ লেজ ঝুলে গেছে৷ যান, ভেতরে যান৷

বিশ্বনাথের চোখের সামনেই অন্ধকার একটা ঝোপের আড়ালে ওরা কুকুরটাকে পিটিয়ে মেরে ফেলল৷ ওখানেই ফেলে রেখে সবাই চলে গেলে বিশ্বনাথ ওপরে এসে সেতার গুছিয়ে রাখল৷ আজ আর বাজানোর মুড নেই৷ খুব ধীরস্থির ভাবে ড্রয়ার খুলে একজোড়া গ্লাভস্ বার করে হাতে পরে নিল৷ তার কুকুরদের ওষুধ খাওয়ানোর সময় এগুলো সে হাতে পরে নেয় সাবধনতার জন্য৷

পাঁচ

অনিল মোহান্তির শরীর তন্ন তন্ন করে খঁুজেও কোথাও কুকুরের কামড়ের চিহ্ণ খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ কুকুরে কামড়ালে সাধারণত ওপরের চোয়ালের ক্যানাইন টিথের দু’টো মার্ক স্পষ্ট বোঝা যায়৷ নীচের চোয়ালের দাঁতের চিহ্ণ কোনও কোনও সময় দেখা যায়৷ কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে তার শরীরের কোথাও ডগ বাইটের চিহ্ণ ছিল না৷ সে নিজেও বলেছে তাকে কোনও দিন কুকুরে কামড়ায়নি৷ তার বাড়ির লোকও একই কথা বলেছে৷ অথচ স্পষ্টতই জলাতঙ্কের লক্ষণ নিয়ে সে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল৷ কিন্তু সে এত দেরি করে এসেছে, আর অ্যান্টি-র্যাবিজ ভ্যাকসিন না নেওয়ার জন্য দ্রুত মৃত্যুর দিকে চলে যায়৷ বাস্তবিক ডাক্তারবাবুরা আশ্চর্য হয়ে যান৷ এটি একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে থানায় রিপোর্ট করেন৷ কেসের তদন্তকারী অফিসার হিসেবে সাব-ইন্সপেক্টর সত্যজিৎ সামন্ত দায়িত্ব পায়৷

প্রাথমিক তদন্ত শেষ হ’লে সে অকূলেই পড়ে রইল৷ ডাক্তারবাবুদের বারে বারে জিজ্ঞেস করেও একই উত্তর পাওায় গেছে— না, পেশেন্টের শরীরে কোথাও কোনও আচঁড় বা কামড়ের চিহ্ণ ছিল না৷ অথচ জলাতঙ্ক রোগের সমস্ত লক্ষণ নিয়ে অনিল মোহান্তকে এনে তার বাড়ির লোক হাসপাতালে ভর্তি করে৷

তখন তার স্নায়ুতন্ত্রে নিউরোট্রপিক ভাইরাস থাবা বসিয়ে দিয়েছে৷ প্রলাপ বকছে, মাসল্-এ স্প্যাজম শুরু হয়েছে, লালা পড়ছে৷ প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা৷ ঘাড় শক্ত হতে শুরু করলে সবাই আশা ছেড়ে দেয়৷

অনিল মোহান্তির নব উন্মেষের ফ্ল্যাটে বসে তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিল ইনভেস্টি -গেটিং অফিসার সত্যজিৎ সামন্ত৷ সদ্য বিধবা, বুঝে শুনে কথা বলা উচিত৷ মানসিক ভাবে আঘাত যাতে না লাগে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়৷

—তাহলে ম্যাডাম, আপনি শিওর অনিলবাবুকে এর মধ্যে কোনও পাগলা কুকুর কামড়ায়নি? বা অন্য কোনও জন্তু বা কীটপতঙ্গ?

—উনি তো আমাদের সঙ্গে বেশি কথা বলতেন না৷ এখানে থাকতেনও কম৷ তবে, পাগলা কুকুরে কামড়ালে জানতে পারতাম৷

—কবে, কীভাবে বুঝতে পারলেন?

ভদ্রমহিলা পুলিশ অফিসারের সামনে স্বচ্ছন্দ বোধ করছিলেন না৷ জড়সড়ো হয়ে বসে ছিলেন৷ কথাও বলছিলেন থেমে থেমে৷ চিন্তা করে উত্তর দিচ্ছিলেন৷

—দিন দশেক আগে বলছিল শরীরে খুব ব্যথা করছে৷ ভাবলাম, হতে পারে৷ সেই ভোরে বেরোয়, বাইরের কাজকর্ম সেরে অফিসে যায়৷ বিকেলে আবার ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ছুটোছুটি৷

—শুনেছি অফিসের ক্যান্টিন…

—হ্যাঁ, আমাকে দেখতে বলেছিল৷ আমি না করে দেওয়ায় আমার ছোটোবোন ওখানে বসে৷ একটা ছেলেও আছে৷

—ও আচ্ছা৷ ক্যান্টিনের মেয়েটি আপনার ছোটো বোন? আর কী কী লক্ষণ ছিল?

—শুধু বলত বমি পাচ্ছে৷ কেমন যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল৷ খিদে ছিল না৷ হঠাৎ খিটখিটে মেজাজের হয়ে পড়েছিল৷

—আর কিছু?

—কেমন যেন অকারণে ভয় পেতে শুরু করেছিল৷ উল্টোপাল্টা কথা বলত৷

—কী বলত মনে আছে আপনার?

ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন৷ তারপর আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছলেন৷

—সরি ম্যাডাম, কিছু মনে করবেন না৷ আসলে অনিলবাবুর মৃত্যুটা ডাক্তারবাবুরা এবং আমাদের ডিপার্টমেন্ট মনে করছে অস্বাভাবিক মৃত্যু৷ সুতরাং রহস্য সমাধান করতে হ’লে আপনার সহযোগিতা দরকার৷ উল্টোপাল্টা কথা কী বলত বলুন তো!

—শুধু বলত— আমার পাপের ফল৷ আবার কখনও প্রলাপের ঘোরে মাধবী, কখনও মালতী বলে ডাকত৷ শেষে যেখন গলার ব্যথায় জলও খেতে চাইত না, আমার সন্দেহ হল৷ পাশের ফ্ল্যাটের গোবিন্দবাবুকে সব বললাম৷ উনি শুনেই বললেন পাগলা কুকুরে কামড়েছিল কিনা? আমার মনে পড়ল না সেরকম কিছু ঘটেছে কিনা৷ তা ছাড়া উনি ওদের গ্রামের বাড়িতেই বেশি থাকতেন৷ ওখান থেকেই বাইকে অফিসে যেতেন৷ অন্য কাজকর্ম করতেন৷

—আপনার কী মনে হয়, কোন পাপের কথা উনি বলতে চাইতেন?

—আমি জানি না, আমি জানি না৷ বলতে বলতে ভদ্রমহিলা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন৷ সত্যজিৎ সামন্ত বুঝল এই বিষয় নিয়ে এখন বেশি কথা বলা যাবে না৷ দু-চারদিন পরে না হয় আবার কথা বলা যাবে৷

—আচ্ছা, মাধবী বা মালতী নামে আপনাকেই কি জ্বরের ঘোরে ভুল করে ডাকতেন? আপনাদের গ্রামের বাড়ি কোথায়?

—না, আমাকে নয়৷ আমাকে ও বিজু বলে ডাকত৷ আমার ভালো নাম পারমিতা৷ গ্রামের বাড়িতে আমি অনেকদিন যাই না৷ এখানে আসার পর একদিনও যাইনি৷ তাও প্রায় বছর দুয়েক৷ আসলে আমার ওখানে যাওয়া ও পছন্দ করত না৷ জায়গাটা আপনার স্টেশন থেকে বড়োদিঘি যাওয়ার পথে ডানদিকে যে কবরখানা পড়ে, সেটা ছাড়িয়ে আর একটু গেলেই প্রমোদপুর৷ ওখানেই৷

—ওখানে অনিলবাবু একা থাকতেন?

—আমি ঠিক বলতে পারব না৷ কোনও দিন জিজ্ঞেস করিনি৷ এসব খোঁজখবর নেওয়া পছন্দ করত না৷ নিন, চা খান৷

চায়ে চুমুক দিতে দিতে সত্যজিৎ ঘরের সাজসজ্জা, আসবাব দেখছিল৷ প্রাচুর্যের ছাপ আছে, কিন্তু সবই বড়ো মোটা দাগের৷ সম্ভবত থ্রি বি এইচ কে৷ ভদ্রমহিলা কিছু লুকোচ্ছেন৷ বেশ স্বচ্ছলতার চিহ্ণ রয়েছে, অথচ অনিল মোহান্ত ছিল ক্লাস ফোর স্টাফ৷ অবশ্যই তার উপার্জনের অন্য কোনও উৎস ছিল৷ সেটা খুঁজে বার করতে পারলে হয়তো সমাধানের কোনও সূত্র পাওয়া যেতে পারে৷ কাল আর একবার ওদের অফিসে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে৷

প্রথমদিন তো মনে হ’ল অনিল মোহান্ত মারা যাওয়ায় অফিসে তাঁর সহকর্মীদের কারো কিছু আসে যায় না৷ এমনকি তাঁর মৃত্যুর খবর সবাই জানেও না৷ সবাই উড়ো উড়ো শুনেছে অনিল মোহান্তকে পাগলা কুকুরে কামড়েছিল৷ তাঁর জলাতঙ্ক হয়েছিল৷ বাস্তবিক সত্যজিৎ অবাক হয়েছিল৷ অফিসে একজন সহকর্মী মারা গেলে যে আবহ থাকা উচিত, তার কিছুই ছিল না৷ খবরটা শুনে সবাই ‘ও তাই নাকি?’ ভাবে দায়সারা উত্তর দিচ্ছিল৷ দু’একজন অবশ্য পুলিশ খোঁজখবর নিচ্ছে দেখে কৌতূহলী হয়েছিল৷ নিরাপদ নস্কর নামে একজনের কাছে খবর পাওয়া গেল অনিল মোহান্ত জমির দালালিও করত৷ এই অফিসে অনেকেই তার কাছ থেকে জমি নিয়েছে৷ কিছুদিন যাবৎ তার চালচলন পাল্টে গিয়েছিল৷ নব উন্মেষে ফ্ল্যাট নিল৷ সে না হোক সত্তর-আশি লাখ হবে৷ দামি সিগারেট খেত৷ পোশাক-আশাক ব্র্যান্ডেড কোম্পানির৷ হঠাৎ করে যেন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ পেয়েছিল৷ অফিসে ওর এই পিয়নগিরি ছিল ধোকার টাটি৷ তবে আমাদের সঙ্গে বেশি কথাবার্তা বলত না৷ দোতলায় ওভাশিয়ারবাবু বিশ্বনাথ সেন— তাঁর সঙ্গে খুব গুজগুজ ফুসফুস চলত৷ নিশ্চয় ওভাশিয়ারবাবুকে জমি গছাতে চেয়েছিল৷ ভীষণ আজগুবি গল্প লোককে শোনাত৷ আমরা পাত্তা দিতাম না৷ বিশ্বনাথবাবু খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন৷ আপনি ওঁর সঙ্গে কথা বলুন, অনিলের অনেক খবর পেতে পারেন৷

বিশ্বনাথের কাছে সতিজিৎ সামন্ত অনেক খবর পেল৷ অনিল মোহান্ত লোকটা বেশ রহস্যময় চরিত্র মনে হচ্ছে এখন৷ সহজসরল মানুষ সে নয়৷ বিশ্বনাথবাবু যে কুকুরের গল্পটা বলল, সেটাও ভয়ঙ্কর৷ যেভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছে, অনিল মোহান্তর হাত-পা ভেঙে যাওয়ার কথা, অন্তত ছড়েটড়ে তো যাবেই৷ বেশি দিনের কথা নয়৷ অথচ তার শরীরে কোথাও আঘাতের চিহ্ণমাত্র নেই৷ আশ্চর্য!  তাহলে মিথ্যে বলছে কেউ৷ কিন্তু শুধু শুধু একটা ভয়ঙ্কর কুকুরের গল্প বাজারে চাউর করে করে কী লাভ! এই ব্যাপারটা সরজমিনে দেখা দরকার৷ এবার ওদের গ্রামের বাড়িতে ঢু মারতে হবে৷ আর অফিসে যাঁরা অনিল মোহান্তর থেকে জমি নিয়েছে, তাদের সবাইকে আর একবার জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার৷ ওভারশিয়ার রেখেঢেকে যা বলেছে, মনে হয় লোকটা মহাজনি কারবারও চালাত৷ তা ছাড়াও লোকটার আয়ের অন্য উৎস আছে৷ সেটাও একটা এই রহস্যময় মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত কোনও সূত্র৷ না, ক্রমশ সুতো আরও জট পাকিয়ে যাচ্ছে৷

—আচ্ছা, এই অনিল মোহান্ত লোকটা কি কুকুরকে খুব ভয় পেত? সাইকোলজিক্যাল ফিয়ার থেকে অনেক সময় মানুষ হ্যালুসিনেশন দ্যাখে৷ হয়তো একা একা ফেরার সময় ওঁর মনে হ’ত একটা প্রকাণ্ড কালো কুকুর ওকে তাড়া করেছে, সেই দৃশ্য মিথ্যে মিথ্যে দেখত৷ এরকম হয়৷

—কুকুরকে ভয় পেত না, ঘেন্না করত৷ কুকুরের ওপর অত্যাচার করে নিষ্ঠুর আনন্দ পেত৷ ওর বাইক দিয়ে চাপা দেওয়া ওর পক্ষে অস্বাভাবিক কিছু নয়৷ তা ছাড়া ওই পথে যাতয়াত করে, এমন কিছু লোক নাকি গভীর রাতে কবরখানার ওদিকে কুকুরের ডাক শুনেছে৷ তাদের ভাষায় বাঘের মতো গর্জন৷

—আপনি নিজে শুনেছেন? মানে ওই লোকজনদের কথা!

—শুনেছি৷ একদিন একটা কাজে অনিলের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম৷ একটা জমির ব্যাপারে খোঁজ নিতে৷ ওখানেই কয়েকজন বলছিল রাত না করে বাড়ি ফিরতে৷  ইবলিশের মতো ভয়ঙ্কর একটা কুকুরের ডাক শোনা যায়৷ দোজখের আগুন নাকি তার দুই চোখে৷ এসব হয়তো ওরা অতিরঞ্জিত করে বলেছে৷ কিন্তু সেদিন ফেরার পথে আমি নিজের কানে কুকুরের ডাক শুনেছি৷ দেশি কুকুরের মতো নয়, রীতিমতো গ্রে- হাউন্ডের মতো গর্জন৷

—সমস্যায় পড়া গেল৷ বাইক থেকে ওভাবে ছিটকে পড়ল, অথচ শরীরে কোথাও চোট-আঘাত লাগল না? আর পাগলা কুকুরের কামড় না খেয়েই মরল কিনা জলাতঙ্কে!

—আমিও তো সমস্যায় পড়েছি৷ এত বড়ো অ্যাক্সিডেন্ট হ’ল, অথচ তার গাড়ির কোথাও একটা আঁচড় পড়ল না৷ যেরকম স্পিডের কথা বলেছে তাতে গাড়িটা ঘষটে ঘষটে বেশ কিছুটা যাওয়ার কথা৷ এদিকে বাইক ঝকঝক করছে৷ তবে, আপনি যেভাবে ব্যাখ্যা করতে চাইছেন, সেটাও হতে পারে৷ কুকুরের গর্জন হয়তো ঠিকই শুনেছিল৷ তারপর ভেবেছিল কুকুরটা ওকে তাড়া করেছে বা করতে পারে৷ তাড়াতাড়ি জায়গাটা পার হয়ে এসেছিল৷ পরে হয়তো রাতে ভেবেছে— কী হতে পারত৷ এবং পরে নিশ্চিন্ত হয় সেটাই ঘটেছিল৷ আমাকে এমন ভাবে ঘটনাটা বলেছিল, যেন সে এখনও চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে৷ তা ছাড়া, অনিলের আজগুবি গল্প বানিয়ে বলারও স্বভাব আছে৷ অফিসে সবাই জানে৷

—উফ্, আপনি আরও ঘুলিয়ে দিলেন৷ বাই দা বাই বিশ্বনাথবাবু, আপনার আঙুলে ওটা কীসের আংটি? তিনকোনা, মনে হচ্ছে লোহার শক্ত তার দিয়ে তৈরি৷

—ও, এটা? আংটি নয়৷ আমার সামান্য গানবাজনার শখ আছে৷ এটার নাম মেজরাপ৷ এটা আঙুলে পরে সেতার বাজাতে হয়৷

—কিছু মনে করবেন না৷ আমাদের তো পুলিশের চোখ, অস্বাভাবিক কিছু দেখলেই নড়েচড়ে বসি৷ একটু দেখান না জিনিসটা৷

বিশ্বনাথ সেন তার আঙুল থেকে মেজরাপ খুলে দারোগাবাবুর হাতে দিল৷ সত্যজিৎ সামন্ত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বিশ্বনাথের হাতে ফেরত দিল৷

—বুঝলেন, মনে হচ্ছে আমাকে স্যারের কাছেই যেতে হবে৷ আমার মাস্টারমশাই৷ ভুটান রাজপরিবারের সেই সোনার বুদ্ধমূর্তি যিনি উদ্ধার করেছিলেন৷ কী আশ্চর্য কো- ইনসিডেন্ট! স্যার, মানে বিজন রায়চৌধুরীও এক সময় সেতার বাজাতেন৷ একটা স্ট্রোকের পর বাঁ হাতটা দুর্বল হয়ে গেছে৷ আমি অবশ্য কোনও দিন বাজাতে শুনিনি৷ তবে ঘরে ছবি আছে৷ স্যারের কাছে আপনার কথা বলব৷ আর একটা কথা, আপনার বাড়িতে একটা কালো কুকুর আছে?

—হ্যাঁ, আছে তো৷ একটা নয়, চারটে কুকুর আছে আমার৷ কালোটা অ্যালসেশিয়ান৷ তাদের দেখাশোনা সব আমার হাতে৷ আজ সকালেই টাইগারকে শ্যাম্পু দিয়ে স্নান করিয়েছি, ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে লোম আঁচড়ে দিয়েছি৷ এছাড়াও পথেঘাটে অসুস্থ কুকুর দেখলে তুলে এনে চিকিৎসা করাই৷ মানুষের মতো ওদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে৷

—নিশ্চয়ই, তবে পাগলা কুকুর মেরে ফেলাই ভালো৷

—একদম ঠিক৷ পাগলা কুকুর মেরে ফেলাই ভালো৷ কে যে কীসে পাগল হয়ে যায়…

—আজ তবে উঠি বিশ্বনাথবাবু৷ আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে হবে৷ আবার হয়তো আপনার কাছে আসতে হবে৷ একদিন সেতার শোনান না! স্যারের বাড়িতে আসরের ব্যবস্থা করি৷ স্যার খুব খুশি হয়ে চাই কী আমার কেসটায় সাহায্যও করতে পারেন৷ এই অনিল মোহান্ত লোকটা, একটু তাড়াতাড়ি ডাক্তার দেখালেই ধরা পড়ত হাইড্রোফোবিয়া হয়েছে৷ আজকাল আবার কেউ মারা যায় নাকি! শেষের দিকে নাকি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল৷

—আপনার স্যার, মানে বিজন রায়চৌধুরী কি প্রাইভেট গোয়েন্দা?

—প্রফেশনাল ন’ন৷ আমরা কখনও দিশাহারা হয়ে পড়লে ওঁর কাছে পরামর্শ নিই৷ ধুরন্ধর লোক৷

—তাই?

ছয়

বিজন রায়চৌধুরী বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে শব্দছক মেলাচ্ছিলেন৷ মূলত ক্রসওয়ার্ড পাজল্ আর সুডোকু করার জন্যই তাঁর তিনটে বাংলা, একটা ইংরেজি কাগজ রাখা৷ শিক্ষকতা থেকে অবসর নেবার পর ইংরেজি উপন্যাস আর এই শব্দছক সমাধান করে তার সময় কেটে যায়৷ একটা সময় ছিল, যখন সেতারের রেওয়াজ করে সকাল আর রাত কেটে যেত৷ অবসর নেবার ঠিক ছ’মাস পরে ছোটো একটা সেরেব্রাল অ্যাটাক হ’ল তাঁর৷ বাঁ হাতটা একদম কমজোরি হয়ে পড়ল৷ ওষুধ, ফিজিও থেরাপি— কোনও লাভ হয়নি৷

রহস্যসন্ধান করে তার কারণ খঁুজে বের করার একটা শখ আছে তাঁর৷ সুকলে পড়ার সময় থেকেই তাঁর এই নেশা৷ অন্যভাবে যে কোনও সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতেন৷ ক্লাস এইটে পল্লবের স্ট্যাম্প কালেক্শনের খাতা ক্লাস থেকেই চুরি হয়ে গেল৷ বুদ্ধি খাটিয়ে সেই অ্যালবাম উদ্ধার করল বিজন রায়চৌধুরী৷ আস্তে আস্তে বুদ্ধিতে আরও শান পড়েছে, মানুষের মনের অতলে গভীর মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো বুঝতে শিখেছেন৷ অপরাধীর মনস্তত্ত্ব নানাভাবে, সম্ভব-অসম্ভব পদ্ধতিতে খঁুজে অপরাধীর সন্ধান পেয়েছেন৷ অপরাধী যখন তাঁর সঙ্গে লুকোচুরি খেলে, তখন তাঁর এক রকম নেশা হয়৷ কে জিতবে বুদ্ধির খেলায়, এই উত্তেজনা একটা নেশার মতো কাজ করে৷ আলাদা করে নেশা বলতে মাঝে মাঝে একটিপ নস্যি৷

সত্যজিৎ তার ছাত্র ছিল৷ সত্যজিতেরও একটা রহস্যসন্ধান এবং সেটা সমাধানের সহজাত দক্ষতা ছিল৷ সত্যজিৎ ফাইন্যাল পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলে তিনি একসেট আর্থার কোনাল ডয়েল কিনে দিয়েছিলেন৷ সত্যজিতের একাগ্র লক্ষ্য ছিলপুলিশের চাকরি৷ সে আশা তার পূর্ণ হয়েছে৷ গত বছর এখানকার থানায় জয়েন করেছে৷ এখানে এসেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল৷ ভুটান রাজপরিবারের সেই সোনার বুদ্ধমূর্তির রহস্য সমাধানের পর তাঁর বেশ নামডাক হয়েছে৷ তাঁর ছবি দিয়ে কাগজে খবর বেরিয়েছিল৷ ভারত সরকার এবং ভুটান সরকার দু’তরফেই সম্বর্ধনা পেয়েছিলেন৷ সত্যজিৎ সে খবর জানত৷ তারপর মাঝে মাঝেই ছোটোখাটো সমস্যা নিয়ে এসেছে৷ গতকাল ফোন করেছিল রোববার সকালে স্যারের একটু সময় হবে কিনা৷ একটু কথা ছিল৷ তাঁর তো এখন শুধুই অবসর৷ সত্যজিৎ দেখা করতে চাইছে, মানে কোনও সমস্যায় পড়েছে৷ আসুক, শোনা যাক৷ অনেকদিন মাথা ঘামানো হচ্ছে না৷

রোববার সকালে তিনি তিনকাপ চা খান৷ আজ দু’কাপ হয়ে যাওয়ার পর অপেক্ষা করছিলেন সত্যজিতের জন্য৷ তৃতীয় কাপ ওর সঙ্গেই খাবেন৷ হাতে আজকের কাগজ, শব্দছকের পৃষ্ঠা সামনে খোলা রয়েছে৷ এক জায়গায় এসে আটকে গেছেন৷ ‘ন’ দিয়ে শুরু অমাবস্যার প্রতিশব্দ, পাঁচ অক্ষরের৷ মনে হচ্ছিল জানেন, কিন্তু কিছুতেই মাথায় আসছিল না৷

বাইরে একটা বাইক এসে থামল৷ নিশ্চয় সত্যজিৎ৷ অফিসের ডিউটিতে নেই, ব্যক্তিগত কাজে বেরিয়েছে৷ ক্যাজুয়াল পোশাকেই বাইক নিয়ে এসেছে সত্যজিৎ৷ তাছাড়া অফিসের ইউনিফর্মে পুলিশের গাড়ি থেকে স্যারের বাড়ির সামনে নামতে কেমন যেন সঙ্কোচ হয় তার৷

—মিনুর মা, লুচি-তরকারি দু’প্লেট৷ চা-ও দু’কাপ দিও৷ এসো সত্যজিৎ৷ ভারী সমস্যায় পড়েছ তো? লুচির কথা শুনেও চোখে আনন্দ নেই৷ বলো, কোন গাড্ডায় পড়েছ? থাক, প্রত্যেকবার এসেই প্রণাম করতে হবে না৷

—ভারী সমস্যা মানে, বেশ ভারী৷ আমার সব তালগোল পাকিয়ে গেছে৷ নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, কোথাও আলোর রেখা নেই৷

—তো, আমাকে লাইটহাউসের কাজ করতে হবে? তুমি জাহাজ পারে আনবে৷ বলো, গল্পটা বলো৷ কিছু বাদ দেবে না, খঁুটিনাটি সব বলবে৷

—আচ্ছা বলুন, পাগলা কুকুরে কামড়ায়নি, অথচ একটা জলজ্যান্ত মানুষ হাইড্রো -ফোবিয়ায় মারা গেল৷ তার শরীরে কোথাও কোনও কামড়ের বা কোনও ক্ষতচিহ্ণ নেই৷

—অ্যান্টিরেবিজ নেয়নি? আজকাল আবার কেউ জলাতঙ্কে মারা যায় নাকি? আর শোনো, শুধু পাগলা কুকুর নয়— বাদুড়, শেয়াল থেকেও হয়৷ কিন্তু একটা বাইট মার্কিং তো থাকবে৷ ঘটনাটা খুলে বলো৷

—একটা অস্বাভাবিক মৃত্যুর কেস রুজু হয়েছে৷ অনিল মোহান্ত নামে একজনকে হাসপাতালে জলাতঙ্কের সমস্ত লক্ষণসহ ভর্তি করা হয়েছিল৷ জ্বর, প্রচণ্ড মাথায় যন্ত্রণা, ডিলেরিয়াম, মাসল্ স্টিফনেস, আলো সহ্য করতে পারছে না, জল খেতে পারছে না৷ প্রায় কোমায় চলে গেছিল৷ কিন্তু তাঁর শরীরে কোথাও কামড় বা আঁচড়ের চিহ্ণ নেই৷ আমাদের কাছে হাসপাতাল থেকে অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর আসে৷

—এই অনিল মোহান্ত লোকটা কী করে?

—ন্যাশনাল হাইওয়ে ডিভিশনের আশ্রমপাড়া অফিসে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী৷ কিন্তু তার আয়ের আরও অনেক সোর্স আছে৷ দেখে শুনে, খবর নিয়ে দেখলাম প্রচুর রোজগার৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার মনে হচ্ছে লোকটার কোনও গোপন আয়ের উৎস ছিল৷

—তোমার এরকম মনে হওয়ার কারণগুলো বলবে?

—দেখুন, লোকটা অফিসে এবং বাইরে সুদে টাকা খাটাত৷ কনস্ট্রাকশনের কাজ, ফলে ঠিকাদারদের ফাইল এদিক-সেদিক, বিল, ওয়ার্ক অর্ডার, টেন্ডার— সব জায়গায় ঠিক মাথা গলিয়ে লাভের গুড় খেত৷ তারপর ছিল জমি কেনাবেচার ব্যবসা৷ প্রোমোটারিও শুরু করেছিল৷ আজকেই একটা সোর্স থেকে খবর পেলাম একটা বউ-এর নামে, একটা নিজের নামে গাড়ি আছে৷ পারসোনাল ইউজের জন্য নয়, অফিসে ভাড়া খাটায়৷ নব উন্মেষের ফ্ল্যাটের দাম ষাট-সত্তর লাখের কম নয়৷ টাকা রোজগারের আরও কোনও ভারী উৎস আছে৷ সেটা জানতে পারলে হয়তো কোনও ক্লু পাওয়া যেত৷

—আর কিছু? লোকটার ব্যক্তিগত স্বভাব-চরিত্র, বিশেষ কোনও মুদ্রাদোষ, কোনও প্রাণী থেকে ভয়… যা যা জানো,

—অফিসে এই অনিল মোহান্তকে কেউ বিশেষ পছন্দ করত না৷ অবশ্য কে-ই বা পাওনাদারকে পছন্দ করেছে! চড়া সুদে অফিসসুদ্ধ লোককে ধারের ফাঁসে আটকে রেখেছিল৷ ওর থেকে জমি কিনেছে বা ক্যাশ লোন নিয়েছে, এমন কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি৷ স্বভাব-চরিত্র সুবিধের ছিল না৷ সরাসরি কেউ বলেননি, কিন্তু বুঝিয়ে দিয়েছে অনিল মোহান্ত গঙ্গাজলে ধোয়া তুলসীপাতা নয়৷ সব গুণই ছিল লোকটার৷ তবে নেশাভাং-এর কথা শুনিনি৷ নেশা বলতে ওই টাকার নেশা৷ মনে হয় রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার চেষ্টা করছিল৷ আরও গল্প আছে৷ ওঁর গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পথে একটা কবরখানা আছে৷ সেখানে নাকি একটা বাঘের মতো হিংস্র কুকুর থাকে৷ সেটার ভয়ে ওদিকে কেউ যায় না৷ মিথ্যে নয়৷ সেই কুকুরের ডাক শুনেছে— এমন দুজন মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি আমি৷ একজন অফিসের ওভারশিয়ার বিশ্বনাথ সেন, অন্যজন মাধবী মণ্ডল৷ বয়স্কা মহিলা৷ খবর নিয়ে জানতে পারলাম, এই মহিলার স্বামী খুন হওয়ার পর তার জমি, বাড়ি আর মেনটেইন করতে পারছিল না৷ সঙ্গে অল্পবয়সি বোন রয়েছে, মালতী৷ অনিল মোহান্ত তাদের জমি-বাড়ি জলের দরে কিনে নিয়ে মাধবী  মণ্ডলকে কবরখানার পাশেই একটি মোটামুটি থাকার মতো ঘর বানিয়ে দেয়৷ অল্পবয়েসি মালতীকে নিজের বাড়ির কাজে বহাল করে৷

—এই মাধবী মণ্ডলের বয়স কত? চলে কীভাবে? বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি আছে?

—দাঁড়ান স্যার, আপনি র্যান্ডম ফায়ার করছেন৷ এই চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ৷ ইয়ে স্যার, চেহারা-স্বাস্থ্যে একটু উগ্রতা আছে৷ বয়স আরও কম মনে হয়৷ আবার ভাগ্যগণনাও করে৷ আমি থাকতেই একজন অবাঙালি এল৷ তাকে বলল— আজ মঙ্গলবার, আজ সে হাত দেখবে না৷ হ্যাঁ, ইলেকট্রিসিটি আছে৷ নইলে মোবাইলে চার্জ দেবে কীভাবে! আমার মনে হয় অনিল ওকে আর্থিক সাহায্যও করত৷

—অনিলের মোবাইল দেখেছ? কললিস্ট চেক করেছ?

—না স্যার, ওর মোবাইল পাওয়া যায়নি৷ হাসপাতালে যখন আনা হয়, তখন সঙ্গে মোবাইল ছিল না৷ তাঁর স্ত্রী বলছে, স্বামীর মোবাইল কোথায় থাকত সে জানে না৷ বাকি থাকল মালতী আর মাধবী মণ্ডল৷ ওরা কেউ কিছু জানে না৷

—গ্রামের বাড়িটা ভালো করে দেখে এসেছ?

—হ্যাঁ স্যার, এদিকার পুরনো বাড়িগুলো যেমন, সেরকমই, অনিলের বাইকটা ঘরে তোলা রয়েছে৷ মালতী বলল তার পরদিন সকালেই অনিল ফ্ল্যাটের বাড়িতে রওনা হয়েছিল৷ জ্বরজ্বর ভাব থাকার জন্য বাইক নেয়নি৷ বাসে করে গেছে৷ আর একটা ব্যাপার স্যার, অনিল মোহান্ত লোকটা পিকিউলিয়ার৷ যত আনক্যানি টাইপ ঘটনা বিশ্বাস করত৷ বলতে ভালোবাসত৷ ভূত, ভগবান, আত্মা, পুনর্জন্ম, জাতিস্মর, অলৌকিক কোনও ঘটনা বলার সময় তাঁর নাকি উত্তেজনায় চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যেত৷ একটা হিংস্র কালো কুকুরের গল্প লোকজনকে খুব শোনাত৷ ওর ধারণা মাধবী মণ্ডলের স্বামী মার্ডার হওয়া রঘু মণ্ডলের সঙ্গে ওই কুকুরটার আত্মাবিনিময় হয়েছে৷ ভাবুন, এযুগেও এমন লোক রয়েছে৷ কুকুরটা নাকি কবর খঁুড়ে মৃতদেহ খায়৷ আজকাল রাতের বেলায় জ্যান্ত মানুষকেও আক্রমণ করছে৷ ওকেও নাকি করেছিল৷ এবং অফিসের সেই বিশ্বনাথ সেনের কাছে গল্প করেছে এক রাতে নাকি কুকুরটা ওকে আক্রমণ করেছিল৷ অনিল মাটিতে ছিটকে পড়েছিল৷ গাড়ি ঘষটে কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার কথা৷ আশ্চর্যের ব্যাপার, তাঁর শরীরে কোথাও আঘাতের চিহ্ণ নেই, তার বাইকও একদম ঝকঝকে৷

—এসব গল্প তোমায় কে বলেছে?

—ওদের আশ্রমপাড়ার অফিসে একমাত্র ওভারশিয়ারবাবু বিশ্বনাথ সেনের সঙ্গেই অনিল বেশি কথা বলত৷ অনিলের যত আজগুবি গল্পের বিশ্বনাথবাবু ছিলেন মনোযোগী শ্রোতা৷ উনিই বলেছেন৷ অনিল নাকি কুকুরটাকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছে৷ আমার বিশ্বাস হয়নি গোটা গল্পটা৷ মনে হয় অনিলের প্রচণ্ড সাইনোফোবিয়া ছিল৷ কুকুর থেকে ভয়৷ কল্পনা করত কুকুরটা ওকে আক্রমণ করেছে, আর ও কুকুরটাকে মেরে ফেলেছে৷ সব সময় বোধহয় ভাবত৷ তার জন্যই ধারণাটা এক সময় ওর কাছে সত্যি মনে হয়েছে৷ হয়তো অন্ধকার পথে হ্যালুসিনেশনও দেখেছে৷ স্যার, এই বিশ্বনাথ সেন কিন্তু সেতার বাজান৷ আপনিও তো একসময় বাজাতেন৷

বিজন রায়চৌধুরী কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে রইলেন৷ সে কতকাল আগের কথা৷ রাত জেগে কত রেওয়াজ করেছেন৷ সেরেব্রাল স্ট্রোক হওয়ার পর বাঁ হাতটা কমজোরি হয়ে গেল৷ ফিজিওথেরাপি করে কিছুটা উন্নতি হয়েছে, কিন্তু আগের মতো আর চলে না৷

—সত্যজিৎ, ভদ্রলোককে একদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে বোলো৷ অনেক পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে৷ তাড়াতাড়ি আসতে বলে দাও৷

—বলেছি স্যার৷ আজ আবার তাহলে ফোন করব৷

—সত্যজিৎ, আমাদের বোধহয় একবার মাধবী মণ্ডলের সঙ্গে দেখা করতে হবে৷ কবরখানাও দেখতে যাব৷ একটা ফোন করতে হবে আমাকে৷ যেদিন অনিলকে হাসপাতালে অ্যাডমিট করা হয়, সেদিন ইমারজেন্সিতে আর এম ও কে ছিল৷ তারপর আই ডি ইউনিটে ডক্টর কে ছিল— এই দুজনের ফোন নাম্বার আমাকে জোগাড় করে দাও৷ ইন্টারেস্টিং কেস৷ নিউরোট্রপিক ভাইরাস কীভাবে অনিলের শরীরে ঢুকল, কুকুর কামড়ায়নি, তবে কি বাইরে থেকে এই ভাইরাস কোনও ভাবে ওর শরীরে ইনজেক্ট করে দিয়েছে! কে দেবে? কার স্বার্থ কাজ করছে? তাঁকে ভাইরোলজি সম্পর্কে জানতে হবে৷ অনিল নিশ্চয়ই স্বেচ্ছায় ইঞ্জেক্শন নেবে না, তাঁর শরীরে কীভাবে ভাইরাস গেল তাহলে?

সত্যজিৎ কোথায় কোথায় ফোন করে দুটো নম্বর জেনে নিল৷

—এই যে স্যার, কাগজে লিখে দিয়েছি৷

—রেখে যাও৷ আমি পরে কথা বলে নেব৷ তুমি সামনের বুধবারে এসো৷ আমাকে একটু ভাবতে সময় দাও৷ পারলে বুধবারে বিশ্বনাথবাবুকে সঙ্গে এনো৷

—তাহলে স্যার সন্ধের পরে, অথবা রোববারে আসতে হয়৷

—তুমি বুধবারে সন্ধের পরই ওঁকে নিয়ে এসো৷ দেরি করব না৷ কাল সন্ধেবেলা এসো৷ সঙ্গে দুজন আর্মড কনস্টেবল নেবে৷

সাত

মামলা গম্ভীর, বুঝলে সত্যজিৎ৷ হাসপাতালে ফোন করেছিলাম৷ ভাগ্য ভালো আমার নাম শুনেছে৷ অনিল মোহান্তর ব্যাপারে সমস্ত রিপোর্ট আমাকে পড়ে শোনাল৷ অনিলের শরীরে স্পষ্টই জলাতঙ্কের সমস্ত লক্ষণ ছিল৷ ভ্যাকসিন দিয়ে আর লাভ ছিল না৷ সম্ভবত আক্রান্ত হওয়ার দিন দশেক বাদে ওকে হাসপাতালে এনেছে৷ ওঁর বাড়ির লোক, মানে ওর স্ত্রী আর ছেলেকে ভ্যাক্সিনেট করা হয়েছে৷ তিনটে শট হয়েছে৷ জিরো, থ্রি আর সেভেন্থ ডে’তে৷ দুটো বাকি আছে৷ ওরাও খুব আশ্চর্য হয়ে গেছে৷ শরীরে কোথাও কামড়ের চিহ্ণ নেই, নখের আঁচড়ের চিহ্ণ নেই, খুব ছোটো কোনও উন্ড নেই, অথচ হাইড্রোফোবিয়া থেকে সময়মতো চিকিৎসা না করানোয় কোমায় চলে গেছে৷

গাড়ি নিয়ে ওরা কবরখানার দিকে রওনা হয়েছিল৷ সত্যজিৎ, বিজন রায়চৌধুরী, একজন এ এস আই, দুজন বন্দুকধারী সিপাই৷ সত্যজিৎ বুঝতে পারছিল না এত সৈন্য -সামন্ত নিয়ে সেখানে যাওয়ার কী দরকার! অপরাধী এখনও খঁুজেই পাওয়া যায়নি, সুতরাং তাঁকে ধরতে যাওয়ার প্রশ্ণই নেই৷ তবে স্যার যখন বলছেন, নিশ্চয়ই কারণ আছে৷

—বুঝলে সত্যজিৎ, মামলা খুব গম্ভীর৷ ডাক্তারবাবু একটা নতুন তথ্য দিলেন৷ তোমরা সেটা পাওনি৷

—কী স্যার? উদ্গ্রীব হয়ে জানতে চাইল সত্যজিৎ৷ একটু মনঃক্ষুণ্ণ্ হয়েছে সে৷ হাসপাতাল, থানায় জানায়নি, অথচ একজন বাইরের লোককে জানাল৷ কী সেই সংবাদ?

যত তুচ্ছই হোক, সেখান থেকেই হয়তো আসল সূত্র বেরিয়ে আসবে৷

—অনিল মোহান্তর ডানহাতের নখের ফাঁকে সবুজ কিছুর গুঁড়ো লেগে ছিল৷ প্রায় কালচে দেখাচ্ছিল সেগুলো৷ ওরা বুঝতে পারেনি৷ এর সঙ্গে ওঁকে কুকুরে কামড়ানোর কোনও সম্পর্ক নেই ভেবে রিপোর্টে আর উল্লেখ করেনি৷

—আপনার কী মনে হয় স্যার? কী হতে পারে ওগুলো?

—ভাবছি৷ কূলকিনারা পাচ্ছি না৷

—এসে গেছি স্যার৷ ওই যে ডানদিকের হালকা জঙ্গল, ওদিকেই কবরখানা৷ আর একটু আগে একটা আলো জ্বলছে, ওটাই মাধবী মণ্ডলের বাড়ি৷ চলুন আগে ওঁর সঙ্গেই কথা বলি৷

—হ্যাঁ, চল৷

—দাসবাবু, একদম সামনে যাওয়ার দরকার নেই৷ গাড়িটা একটু আড়ালে রাখতে হবে৷ ওই যে, ওই ঝোপটার পাশে রাখুন৷ হেডলাইট বা অন্য কোনও লাইট জ্বালাবেন না৷ আসুন আপনারা৷ দীপঙ্কর, চলো এগোই৷ আসুন স্যার৷ তোমরা দুজন বন্দুক নিয়ে পেছনেই বসে থাকো৷ একটু সতর্ক থেকো৷

খুব সাবধানে পা ফেলে প্রায় নিঃশব্দেই ওরা এগোচ্ছিল৷ দরজার কিছুটা কাছাকাছি আসার পর ভেতর থেকে আওয়াজ এল— কে? মহিলার কান তো বেশ সরেস— ফিসফিস করে বললেন বিজন রায়চৌধুরী৷

—আমি, দিদি৷ এর আগে একদিন আপনার কাছে এসেছিলাম৷ সত্যজিৎ সামন্ত৷ অনিলবাবুর ব্যাপারে কিছু কথা ছিল আপনার সঙ্গে৷

—আপনার সঙ্গে আর কে কে আছে?

—আমার দুই বন্ধু আছে৷ ওরা একটু বিপদে পড়েছে৷ হাত দেখাবে৷

—আমি রাতে প্রায় কিছুই দেখতে পাই না৷ ওদের বাইরে রেখে আপনি একা আসুন৷

তখনই কুকুরের ডাক শোনা গেল৷ অনেক দূর থেকে ভারী আওয়াজ আসছে৷ গমগম করে ডাকটা ছড়িয়ে পড়ছে৷ বিজন রায়চৌধুরী আর সত্যজিৎ সামন্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ ওরা দুজনেই ডাকের উৎসের দিকে তাকিয়ে দূরত্ব আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল৷

—সত্যজিৎ, আর কোথাও কোনও কুকুরের ডাক শুনতে পাচ্ছ?

— না স্যার৷ 

—ব্যাপারটা অদ্ভুত না?

ভেতর থেকে দরজা খোলার শব্দ শোনা গেল৷ ওরা ঘন হয়ে দাঁড়াল৷ দরজা একটু ফাঁক হতেই ওরা সবাই প্রায় জোর করেই দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে পড়ল৷ এর আগের দিন সত্যজিৎ সাধারণ পোশাকে বাইক নিয়ে এসেছিল৷ আজ ফুল ইউনিফর্মে দুজন অফিসার, সঙ্গে একজন বৃদ্ধকে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়তে দেখে মাধবী মণ্ডলের মুখ সাদা হয়ে গেল৷ পিছিয়ে গিয়ে পাশের ঘরের দরজার চৌকাঠে দাঁড়াল৷

—দিদি ভয়ের কিছু নেই৷ আমরা, এই সাধারণ ডিউটি করতে বেরিয়েছি৷ কয়েকটা প্রশ্ণের আমরা উত্তর পাচ্ছি না, ফলে অনিলবাবুর মৃত্যুর রহস্য সমাধান করতে পারছি না৷ বাইরের সুকটিটা কি আপনার?

—আমি তো যা জানি, সব বলেছি আপনাকে? হ্যাঁ, আমার৷

বিজন রায়চৌধুরী মাধবী মণ্ডলকে দেখে চমকে উঠেছিলেন৷ মাঝবয়সি মহিলা, কিন্তু অসম্ভব উগ্র তাঁর যৌবন৷ মুখশ্রীতে বাঙালি লাবণ্য নেই, বরং উত্তরভারতীয় কাঠিন্য রয়েছে৷ মুখের ডৌল সুন্দর, কিন্তু সব কিছু এত তীক্ষ্ন যে, বেশিক্ষণ তাকানো যায় না৷ কিন্তু একবার দেখলে যে-কোনও পুরুষকে আবার তাকাতে বাধ্য করে৷ যাকে বলে নারীর মোহিনী রূপ, একদম তাই৷ এই রকম নারীর কথা ভেবেই রবীন্দ্রনাথ হয়তো লিখেছিলেন, ‘অকস্মাৎ পুরুষের বক্ষমাঝে চিত্ত আত্মহারা, নাচে রক্তধারা…৷’ এই রকম ঊর্বশীদের জন্যই যুদ্ধ হয়, মানুষ সংসার ভুলে যায়৷ সব ভুলে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে৷ এর স্বামী যে খুন হয়েছে, সেটা আশ্চর্যের কিছু নয়৷

ঘরের আসবাব দেখছিলেন তিনি৷ এখন আর কোথাও কুকুর ডাকছে না৷ দেওয়াল জোড়া বিশাল এল ই ডি টিভি৷ সুন্দর শো-কেস৷ ভেতরে দামি পুতুল সাজানো৷ সালোয়ার- কামিজ পরে রয়েছে মাধবী, কিন্তু দোপাট্টা ইউজ করেনি৷ হালকা প্রসাধনও করেছে৷

—আজ কি আপনার এখানে কারও আসার কথা আছে?

—কই, না তো৷ বিজন রায়চৌধুরীর কথা শুনে সামান্য চমকে উঠল মাধবী৷

—তাহলে, আপনি বলছেন অনিলবাবুর মোবাইল কোথায় আপনি জানেন না? আপনার সঙ্গে শেষ কবে কথা হয়েছে অনিল মোহান্তর?

—ওঁর মোবাইল কোথায় আছে, আমি কী করে জানব বলুন? তাঁর স্ত্রীর কাছে খোঁজ নিন৷ আমার প্রমোদপুরের অনেক পুরনো ভাঙাচোরা বাড়ি জমিসহ উনি কিনে নিয়ে এখানে আমাকে থাকার জায়গা করে দিলেন৷ একা থাকি, রাতে অবশ্য মালতী থাকে— মাঝে মাঝে এসে খোঁজখবর নিয়ে যেতেন৷ বলুন, এর মধ্যে অন্যায় কোথায়? আর ওঁর সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়েছে যেদিন গ্রামের বাড়ি থেকে নব উন্মেষের ফ্ল্যাটে চলে গেলেন৷ সেদিন সকালে৷ বলেছিলেন জ্বর-জ্বর লাগছে৷

—হুঁ, তার মানে একুশ তারিখে৷ দেখি আপনার মোবাইলটা৷

একটু ইতস্তত করে সত্যজিতের হাতে মোবাইল তুলে দিল মাধবী৷ দ্রুত কললিস্ট চেক করল সত্যজিৎ৷

—ঠিক আছে৷ একুশ তারিখে আপনার দুটো কল আছে৷ অনিল মোহান্তর সঙ্গে দুবার কথা হয়েছে আপনার৷ 

—হ্যাঁ, পরে আমি আবার ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলাম ডাক্তার দেখিয়েছে কিনা! যদিও জানতাম দেখাবে না৷ অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসায় বিশ্বাস ছিল না৷ কিছু হলে শিকড়, গাছের পাতা, তাবিজ-কবচ, এসব জড়িবুটি করত৷ ইঞ্জেকশন ভীষণ ভয় পেত৷

—নিন, মোবাইলটা রাখুন৷

—একটু চা খাবেন তো? এখনই হয়ে যাবে, গ্যাসে বসাব৷

—হ্যাঁ, চা হলে মন্দ হয় না৷ ইয়ে, পাঁচকাপ বসাবেন৷ বাইরে আমাদের দুই বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে৷ সিগারেট-ফিগারেট খাচ্ছে বোধহয়৷

বিজন রায়চৌধুরীর কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল মাধবী, তারপর ভেতরের ঘরে ঢুকল৷ 

চমকে উঠল সবাই৷ আবার সেই ভয়ঙ্কর কুকুরের ডাক৷ শুনলেই বুকের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে আসে৷ এবার আর দূর থেকে নয়, আওয়াজটা অনেক কাছ থেকে আসছে৷ সত্যজিৎ তাকাল তার স্যারের দিকে৷ স্যার ভুরু কঁুচকে রয়েছেন৷ সত্যজিতের চোখের দিকে তাকিয়ে আস্তে বললেন— সেম৷

—কী সেম স্যার? এতক্ষণে এ এস আই দীপঙ্কর কথা বলল৷

—আপনি নিশ্চয়ই গ্রে-হাউন্ডের কথা বলছেন স্যার?

—পরে বলব৷

একটু বাদেই একটা সুন্দর ট্রে-র ওপর পাঁচকাপ চা এনে রাখল মাধবী৷ সঙ্গে বিসুকট৷

—একটা কাজ করবেন, তিনকাপ এখানে রেখে দু’কাপ বাইরে দিয়ে আসবেন৷ রামলাল বলে ডাক দিলেই ওরা এসে চা নিয়ে যাবে৷ প্লিজ৷

ট্রের ওপর দু’কাপ চার আর বিসুকট নিয়ে মাধবী ঘরের বাইরে যেতেই এক লাফে বিজন রায়চৌধুরী পাশের ঘরে ঢুকলেন৷ দেখলেন দেওয়ালজোড়া আলমারি৷ একটার হাতল ধরে ঘোরাতেই পাল্লা খুলে গেল৷ অন্তত গোটা বারো ছোটো মাপের ট্রলি ব্যাগ৷ প্রত্যেকটাতেই তালা মারা৷ অন্য দেওয়ালের সুইচবোর্ডে গিয়ে যা খঁুজছিলেন পেয়ে গেলেন৷ কালো বোতামটা টিপে ধরতেই তিনি চমকে উঠলেন৷ একেবারে ঘরের পাশেই হিংস্র কুকুরের গর্জন৷ ঠাণ্ডা মাথায় কুকুরের ডাক শুনলেন, তারপর মৃদু হাসলেন বিজন রায়চৌধুরী৷ এ-ঘরে ফিরে এসে দেখলেন সবাই কেমন হতচকিত হয়ে বসে আছে৷ বাইরে কার যেন দৌড়ে যাওয়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে৷

—সত্যজিৎ, তাড়াতাড়ি বাইরে যাও৷ দীপঙ্কর, তুমিও যাও৷ মাধবী মণ্ডল পালিয়ে যাচ্ছে৷ ওই শোনো, সুকটি স্টার্ট দেবার আওয়াজ৷ আর পাবে না ওকে৷ অন্ধকারে কোন গলি দিয়ে কোন জঙ্গলে ঢুকে বসে থাকবে, খঁুজে পাবে না৷ ওর পেছনে দৌড়ে এখন কোনও লাভ নেই৷ জালের ফুটো দিয়ে ছোটোমাছ গলে বেরিয়ে গেছে৷ অপেক্ষা করো, এখনই বড়ো মাছ আসবে৷

—কী বলছেন স্যার, কিছুই বুঝতে পারছি না৷

—সব পরে বলব৷ আপাতত শুনে রাখো তিনবার কুকুরের ডাক হ’ল সিগন্যাল৷ অল ক্লিয়ার, আসতে পারো৷ আমি তৃতীয়বার না বাজালে মাধবী ফিরে আসত৷ তারপর আমরা বেরিয়ে গেলেই মাধবী থার্ড বেল বাজাত৷ মঞ্চে নায়কের প্রবেশ৷ বিজনেস ডিল৷

—আপনি বাজালেন মানে? কুকুরের ডাক আপনি বাজালেন?

—অনিল মোহান্ত খুবই ধুরন্ধর৷ তিনটে বক্স ব্যবহার করেছে৷ একটা দূরে কবরখানার পাশে সম্ভবত৷ একটা মাঝারি দূরত্বে, আর একটা একদম বাড়ির পাশে জঙ্গলের আড়ালে৷ পরপর বাজলে মনে হবে কুকুরটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে৷ সত্যজিৎ, তোমার খেয়াল করা উচিত ছিল তিনবারই কুকুরের ডাকের প্যাটার্ন একই রকম৷ দ্বিতীয়বারের আওয়াজ শুনে তাই বলেছিলাম— সেম! হাউ— হাউ— হাউ৷ যন্ত্রে কী করে ভ্যারাইটি আসবে! একবারই কোনও বিদেশি কুকুরের ডাক রেকর্ডিং করা হয়েছে৷ সেটাই বাজায় সংকেত হিসেবে৷ আসলে কবরখানার দিকে যাতে কেউ না যায়, সেই চেষ্টাও ছিল৷ ভয়ঙ্কর একটা কুকুরের গল্প বাজারে চালু করে দিয়েছিল৷ এই চুপ, একটা বুলেটের আওয়াজ পাচ্ছি৷ এদিকেই আসছে৷ সত্যজিৎ, দীপঙ্কর, তোমরা অ্যালার্ট থাকবে৷ আমরা ঘরে থাকব৷ একটা লোক আসবে৷ আমি দরজা খুলে সরে দাঁড়াব, মুহূর্তের মধ্যে ওকে কাবু করে ফেলতে হবে৷ এ কিন্তু মাধবী নয়৷

—আপনি শিওর, কেউ আসবে?

—আসতেই হবে, নইলে মাধবী পালাত না৷ এতক্ষণে একটিপ নস্যি নিলেন বিজন রায়চৌধুরী৷

বাইকটা এসে উঠোনে দাঁড়াল৷ ইঞ্জিন বন্ধ হ’ল৷ ভারী জুতোর শব্দ এগিয়ে আসছে দরজার দিকে৷ সত্যজিৎ ঘরের এক কোণে, দীপঙ্কর অন্য কোণে হাতে পিস্তল নিয়ে অপেক্ষা করছে৷ জুতোর শব্দ দরজার সামনে এসে থামল৷ দরজায় নক করল তিনবার৷ বাইরে থেকে বলল— মুঙ্গেরিলাল৷ পাল্লার একপাশে শরীরটা লুকিয়ে আস্তে দরজাটা খুলে দিলেন বিজন রায়চৌধুরী৷ ছোটো একটা ট্রলিব্যাগ নিয়ে লোকটা ঘরের ভেতরে পা দিল৷ ঘরে ঢুকেই তার নাকের পাটা ফুলে উঠল৷ বিপদের গন্ধ পেল লোকটা৷ লম্বাচওড়া চেহারা, মাথায় ছোটো ছোটো চুল, বাহারি গোঁফ৷ মুহূর্তে অ্যাবাউট টার্ন হয়েই ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল সেই মুঙ্গেরিলাল৷ দীপঙ্কর আর সত্যজিৎ একসঙ্গে লাফ দিয়েছিল, কিন্তু লোকটার ভারী শরীর হলেও অত্যন্ত ক্ষিপ্র৷

—রামলাল, ভগলু, জলদি বাহার নিকলো৷ পকড়ো উসকো৷ উয়ো ভাগ রহা৷

মুঙ্গেরিলাল ভাবতে পারেনি সামনেও দুজন পাহারাদার রয়েছে৷ সামান্য আলোয় কনস্টেবল দুজন দেখল ভারী চেহারার একজন লোক, একটু আগেই বাইক নিয়ে এসেছে লোকটা— এই লুকিয়ে রাখা গাড়ির দিকেই ছুটে আসছে৷ সামনে আসতেই রামলাল তার বন্দুকের কুঁদো দিয়ে লোকটার কানের নীচে মারল৷ লোকটা ধপ্ করে পড়ে যেতেই সত্যজিৎ আর দীপঙ্কর পৌঁছে গেছে৷

লোকটাকে পিছমোড়া করে বেঁধে দুজন কনস্টেবলের মাঝখানে বসিয়ে রাখা হয়েছে৷ রামলাল আর ভগলুকে সত্যজিৎ বারে বারে সাবধান করে দিয়েছে লোকটা সম্পর্কে৷ এ কিন্তু বিপজ্জনক আসামী৷ পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে৷

মাধবী মণ্ডলের ভেতরের ঘরে ওরা তিনজন৷ আলমারির পাল্লা খুলে ছোটো ছোটো ব্যাগগুলো নামিয়েছে দীপঙ্কর আর সত্যজিৎ৷ বাইরে গিয়ে একটা বড়ো পাথর নিয়ে এসেছে দীপঙ্কর৷ ঘরে এদিক-ওদিক খুঁজতেই একটা হাতুড়ি পাওয়া গেল৷ পাথরের ওপর একটা ব্যাগের তালা রেখে হাতুড়ি দিয়ে তালা ভেঙে ফেলল সত্যজিৎ৷ চেন টেনে ব্যাগের মুখ খুলেই সত্যজিৎ হাঁ হয়ে গেল৷

—স্যার…

—হুম, যা আন্দাজ করেছিলাম৷ অনিল মোহান্ত বে-আইনি অস্ত্রের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছিল৷ এগুলো সব মুঙ্গেরের হাতে তৈরি পিস্তল৷ এই বাড়ি ছিল ওদের ট্র্যানজিট পয়েন্ট৷ আমদানি আর রপ্তানির ঠিকানা৷ ইনভেস্ট করত অনিল, ব্যবসা চালাত মাধবী৷ মুঙ্গের থেকে অস্ত্র নিয়ে যাঁরা আসত, তাদের সবারই নাম ছিল মুঙ্গেরিলাল৷ তিনবার টোকা দিয়ে কোড নাম বললেই মাধবী দরজা খুলে দিত৷ তার আগে মাধবী তিনবার কুকুরের ডাকের রেকর্ডিং চালাত৷ এসব আওয়াজ আজকাল প্রি-রেকর্ডেড সিডি বা ক্যাসেটে পাওয়া যায়৷ কুকুরের ডাক, বাঘের ডাক, ঝড়বৃষ্টির শব্দ, ট্রেনের হুইসেল, অনেক লোকের হইচই৷ নাটকের এফেক্ট মিউজিক হিসেবে ব্যবহার হয়৷ খঁুজলে তুমি এই ঘরেই সেই মেশিন পাবে৷ তার টেনে নিয়ে গেছে সেই কবরখানা পর্যন্ত৷ সেখানে একাট বক্স মাঝামাঝি জায়গায় হয়তো গাছের ওপরে একটা, আর একটা ঘরের পাশে৷  মনে হয় কুকুরটা ক্রমশ কাছে আসছে৷ কিন্তু তিনবারই একই নিয়মে ডেকেছে, একবিন্দুও ভ্যারাইটি নেই৷ আচ্ছা, কখনও কি খেয়াল করে দেখেছ মাধবী আমাদের সামনে রয়েছে, কিন্তু কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে? একবার আমরা ঘরে ঢোকার আগে শুনেছি৷ অনেক দূর থেকে আওয়াজটা আসছিল৷ দ্বিতীয়বার শুনলাম, যখন মাধবী চা বানাতে রান্নাঘরে গেল৷ বুঝতে পেরেছিলাম এটা স্বাভাবিক সমাপতন নয়৷ মাধবীর হাত আছে৷ তা ছাড়া, বোঝাই যাচ্ছিল এটা যান্ত্রিক আওয়াজ৷ রাতের বেলায় সাধারণত লেনদেন হ’ত৷ তখন যাতে এদিকে কেউ না আসে, তাই হিংস্র কুকুরের গল্প আর গর্জন চাউর করে দিয়েছিল৷

—মাধবী পালাল কেন? ও-ই যে লেনদেন করে, তার তো কোনও প্রমাণ নেই৷

—ওঁর পালিয়ে যাওয়ার কারণ দু’টো৷ তৃতীয়বারের জন্য কুকুরের ডাক শুনে নার্ভাস হয়ে পড়েছিল৷ এক— যান্ত্রিক কারসাজি আমরা ধরে ফেলেছি৷ তার মানে ভেতরের ঘরে অস্ত্রগুলো ধরা পড়ে গেছে৷ ইল্লিগাল আর্মস্ ট্র্যাফিকিং-এ রেহাই পাওয়া মুশকিল৷ দুই— তিনবার কুকুরের ডাক শোনা গেছে, মানে আজ যার মাল নিয়ে আসার কথা মুঙ্গের থেকে, সে নিশ্চিন্তে ওই বাড়িতে যাবে! আর পুলিশের হাতে ধরা পড়লে সবই ফাঁস হয়ে যাবে৷ আমার ধারণা অনিল মোহান্ত মাধবীর রূপযৌবনের টোপ দিয়ে সমাজের বিশিষ্ট মানুষদের আকৃষ্ট করত৷ তারপর ব্ল্যাকমেলিংয়ের ভয় দেখিয়ে তাদের ক্ষমতাকে ব্যবহার করত৷ তোমরা থানায় নিয়ে মুঙ্গেরিলালকে ভালো করে ক্রস করো৷ সব খবর পেটের থেকে বেরিয়ে যাবে৷ অনিল মোহান্ত ওকে ব্ল্যাকমেল করত কিনা, মনে করে জিজ্ঞেস করবে৷ দরকার হলে তোমার রুলারের গুঁতো দিতে পার দু’চার ঘা৷ আর দীপঙ্কর, তুমি গাড়িতে যাও৷ ওয়াকিটকিতে থানায় খবর দাও একটা গাড়ি পাঠাতে৷ অত আর্মস, ক্যাশও প্রচুর পাওয়া যাবে আশা করি— সব নিয়ে যেতে হবে৷

—স্যার, আমরা এগুলো বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যাচ্ছি, আপনি লিস্টে পাবলিক উইটনেস হিসেবে একটা সই দেবেন৷

—সে নিশ্চয়ই দেব৷ এখন ওপরে তাকাও৷ কী দেখতে পাচ্ছ? কাঠের সিলিং৷ সুন্দর সাদা রং-করা৷ কোণের দিকে কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার দেখতে পাচ্ছ?

—পাচ্ছি স্যার৷ সিলিং-এর সব জায়গায় ঝুলকালি রয়েছে, ওই জায়গাটুকু পরিষ্কার৷ কিন্তু স্যার এ-ঘরে দেওয়াল ঘেঁষে মইটা কেন রয়েছে?

—কী করে যে তোমরা পুলিশে চাকরি করো, আবার খুনখারাপির তদন্ত করো৷ মইটা দিয়ে সিলিং-এর ওখানে সেট করে সামান্য ঠেললেই একটা ডালা ভেতরের দিকে খুলে যায়৷ সিলিং-এর ভেতরেই টাকাপয়সা সম্ভবত থাকার কথা৷ সত্যজিৎ ওঠো, টর্চটা  নাও৷

দেওয়ালের কোণে মই লাগিয়ে সাবধানে সত্যজিৎ সিলিং পর্যন্ত উঠল৷ তারপর নির্দিষ্ট জায়াগায় ঠেলা দিতেই ভেতরের দিকে ডালা খুলে গেল৷ ওখানে দাঁড়িয়েই জোরালো টর্চের আলো ভেতরে ফেলল সত্যজিৎ৷ চারদিকে ভালো করে ফোকাস করে পরীক্ষা করল৷

—স্যার, কোথাও কিছু নেই৷ কিন্তু কাঠের তক্তার ওপর ধুলো, সেখানে অনেক পায়ের ছাপ রয়েছে৷ ছোটো ছোটো, মনে হয় মেয়েদের পায়ের ছাপ৷

—যাঃ, টাকা সরিয়ে ফেলেছে মাধবী৷ অনিলের মৃত্যুর খবর পেয়েই সব টাকা সরিয়ে ফেলেছ৷ কিন্তু সরাবে কোথায়? সত্যজিৎ, তুমি অনিলের গ্রামের বাড়ি চেন, যেখানে মালতী থাকে?

—চিনি স্যার, একবার গিয়েছি৷

—এক্ষুনি যাও৷ বাইরে ওই মুঙ্গেরিলালের বাইক পড়ে আছে৷ চাবি খোলাই আছে৷ দু’বোনকে একসঙ্গে পেয়ে যেতে পার৷ টাকা সরিয়ে বোনের কাছেই রেখেছে৷ কী হ’ল, ফোনে জানাবে৷

—স্যার, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? দীপঙ্কর এতক্ষণ অবাক হয়ে বিজন রায়চৌধুরীর কথা শুনে যাচ্ছিল, এবার একটু ফাঁকা পেতেই কথা বলার সুযোগ পেল৷

—হ্যাঁ, বলো৷ কী জানতে চাও৷

—লোকটা ঘরে ঢুকে কোনও কিছু না দেখেই মনে হ’ল যেন বাতাসে বিপদের গন্ধ পেয়েছে৷ মুহূর্তেই বুঝে ফেলল ওঁর জন্য ফাঁদ পাতা হয়েছে৷ আমাদের কনস্টেবল দুজন না থাকলে তো পালিয়েই যেত৷

—ঠিকই বলেছ, লোকটা বাতাসে বিপদের গন্ধ পেয়েছিল৷ ওদের সব সময় বিপদ ঘাড়ে নিয়ে কাজ করতে হয়৷ ফলে আমাদের চেয়ে ওদের ইন্দ্রিয় অনেক বেশি সংবে… ইয়ে কী বলে, সেন্সেটিভ৷ ভুল আমারই৷ কেন যে এই ছোট্ট ভুলটা করে ফেললাম! মনে পড়ে লোকটা ঘরে ঢোকার আগে আমি কী করছিলাম?

—দরজার পাল্লার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলেন৷

—না, তোমাদের দ্বারা হবে না৷ আরে আমি একটিপ নস্যি নিয়েছিলাম৷ তুমিই তো হাঁচতে গিয়েও সামলে নিলে৷ এখন ঘরে ঢুকেই ওর অনভ্যস্ত নাকে নস্যির গন্ধ যেতেই বুঝতে পেরেছে কিছু একটা স্বাভাবিক নেই৷ তা ছাড়া, অন্যদিন মাধবী দরজা খোলে, আজ যেন আপনা থেকেই খুলে গেল৷ সঙ্গে সঙ্গে বুঝেছে ফাঁদে পা দিয়েছে৷ পালিয়েছে৷

ফোন বেজে উঠল বিজন রায়চৌধুরীর৷ ব্যস্ত হয়ে কল রিসিভ করলেন৷

—হ্যালো সত্যজিৎ, হ্যাঁ বলো! ্যাঁ, বাড়িতে কেউ নেই? দুজনই পালিয়েছে? সুকটিতে? তাহলে ধরে ফেলতে পারবে তোমরা৷ সে কী? সুকটি ফেলে রেখে বাইক নিয়ে পালিয়েছে! আহা রে অনিল মোহান্তর বাইকটা দেখার আমার বড়ো ইচ্ছে ছিল৷ ঠিক আছে, আমাকে দীপঙ্কর বাড়িতে নামিয়ে দেবে৷ তুমি ওই বাইক নিয়ে থানায় চলে যাও৷ হ্যাঁ হ্যাঁ, সইসাবুদ করে দেব৷ গুনতে তো একটু সময় লাগবে৷ অত আর্মস, ইলেক্শনের আগে লোকজনের হাতে ছড়িয়ে পড়লে কী বিপদ হত কে জানে! কেমন কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরল৷ আমাদের সময়ে টিভিতে একটা সিরিয়াল হ’ত৷ তোমরা বোধহয় দেখনি৷ আমরা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটে দেখেছি৷ মুঙ্গেরিলালকে হাসিন স্বপ্ণে! দেখেছ?

—না স্যার৷ যাই, ট্রলি ব্যাগগুলো গুনি৷

আট

বুধবারের সন্ধ্যা৷ বিশ্বনাথ সেনকে নিয়ে সত্যজিতের আসার কথা৷ বিশ্বনাথের বাড়ির ঠিকানা সত্যজিৎ দিয়েছিল৷ তাঁর কাজের পদ্ধতি অনুযায়ী আজ দুপুরে সেদিকে গিয়েছিলেন রেইকি করতে৷ বেশ ভালো মুড নিয়ে ফিরে এসেছেন৷

আজ বিকেল থেকেই পশ্চিমের আকাশে লাল মেঘে ছেয়ে ছিল৷ অদ্ভুত একটা আলো ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবী জুড়ে৷ কিন্তু এই মায়াময় আলো তিনি দেখছিলেন না৷ তার দৃষ্টি মেঘ ছাড়িয়ে আরও দূরে কিছু খঁুজছিল৷ অনিল মোহান্তির কেসটা জেনুইন খুনের কেস৷ কোনোভাবে তার শরীরে জলাতঙ্কের ভাইরাস ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ খুনি অসম্ভব চালাক৷ হতে পারে টাকাপয়সা নিয়ে কারও সঙ্গে ঝামেলা৷ আশ্চর্য! কোথাও কোনও চিহ্ণ নেই, অথচ লোকটা নিজেও জানতে পারেনি তার শরীরে মৃত্যুদূত ঢুকে গেছে৷ অনেকগুলো সম্ভাবনা মাথায় ঘুরছে, কিন্তু পাশাপাশি আর লম্বালম্বি মিলছে না৷

বিকেল গড়িয়ে আরও একটু সন্ধের দিকে গেল৷ পশ্চিম দিগন্তে, যেখানে সূর্য এইমাত্র ডুব দিল, সেখানে জবাফুলের রং৷ গেটের সামনে একটা গাড়ি দাঁড়ানোর শব্দে তাঁর ভাবনা ছিঁড়ে গেল৷ জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলেন সত্যজিৎ নামছে৷ সঙ্গে মাঝবয়সী  এক ভদ্রলোক৷ কালো প্যান্ট, সাদা ফুলস্লিভ শার্ট৷ চোখে চশমা৷ ইনিই বোধহয় বিশ্বনাথ সেন৷ উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন৷

—এসো সত্যজিৎ৷ নমস্কার, ভেতরে আসুন৷ আপনি নিশ্চয়ই বিশ্বনাথ সেন! আমি সত্যজিতের মাস্টারমশাই বিজন রায়চৌধুরী৷

বিশ্বনাথ হাত জোড় করে নমস্কার জানাল৷ বিজন দেখলেন অসম্ভব উজ্জ্বল একজোড়া চোখ৷ গভীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি সেই চোখে৷

—আমি ভেবেছিলাম আজ আপনার সেতার শুনব৷ সত্যজিৎকে বলেছিলাম৷

—আসলে, তবলা ছাড়া… ঠিক জমে না৷ আর আমারও আঙুলে একটু ব্যথা রয়েছে৷ শুনেছি আপনিও বাজাতেন৷

—সে গতজন্মের কথা৷ সব ভুলে গেছি৷ কোন ঘরানার তালিম আপনার?

—আমার মাইহার ঘরানা৷ আপনার?

—আমি মণিলাল নাগের কাছে শিখতাম৷ বিষ্ণুপুর ঘরানা৷ একটা সেরেব্রাল স্ট্রোকে বাঁ হাতটা কমজোরি হয়ে গেল৷ দয়া করে একদিন সেতার নিয়ে আসবেন৷ না হয় জয়জয়ন্তীর আলাপজোড় শুনব৷ বাই দা বাই, আঙুলে ব্যথা বলছিলেন, কেটেছে নাকি?

—চিকারির তারের মাথা ফুটে গেছিল৷ জানেন তো কত সূক্ষ্ম তারের মাথাটা, অথচ কী শক্ত! তার পরানোর সময় একটু অসাবধান হ’লেই ফুটে যায়৷ ভীষণ ব্যথা হয়৷

—জানি৷ আমারও কতবার হয়েছে৷ মরচে ধরা তার হ’লে কিন্তু টিটেনাসের ভয় আছে৷ ওষুধ লাগিয়েছেন?

—ওই, তুলোয় এক ফোঁটা ডেটল নিয়ে কিছুক্ষণ চেপে ধরে রেখেছি৷ তা ছাড়া, আমার সব ভ্যাকসিন নেওয়া আছে৷ বাড়িতে চারটে কুকুর, কখনও রাস্তার কুকুরদেরও দেখাশোনা করি৷ আমার আবার ভীষণ কুকুরপ্রীতি আছে৷ ওরাই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেয়৷

অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবছিলেন বিজন রায়চৌধুরী৷ বিশ্বনাথের শেষ কথায় তার অন্যমনস্কতা ভাঙল৷ তুলোর কথা কী যেন বলছিল বিশ্বনাথ!

—হ্যাঁ বিশ্বনাথবাবু, যেজন্য আপনার সাথে দেখা করার দরকার আমার, সেটা হ’ল অনিল মোহান্তর সম্পর্কে কিছু ইন্ফরমেশন৷ শুনলাম অফিসে আপনার সঙ্গেই একমাত্র তার সখ্য ছিল৷

—হাঃ হা৷ সখ্য নয়, তাঁর আজগুবি গল্প শোনার আমি একমাত্র সিরিয়াস শ্রোতা ছিলাম৷ খুব উৎসাহ নিয়ে গল্পগুলো শোনাত৷

—আপনার কী মনে হয় অনিল নিজে সেগুলো বিশ্বাস করত?

—হতে পারে৷ আমার মনে হ’ত গভীর বিশ্বাস নিয়ে অনিল আমার কাছে গল্পগুলো বলত৷ দু’হাত ভর্তি গ্রহরত্ন৷ অফিসে অবশ্য কেউ বিশ্বাস করত না ওর এইসব গালগল্প৷ রিসেন্টলি একটা কুকুরের গল্প খুব বলত৷ আমার মনে হয় এটাও বানিয়ে বলত৷

—ব্যক্তিগত ভাবে অনিল মোহান্ত কেমন মানুষ বলে আপনার মনে হয়?

বিশ্বনাথ সেন কিছুক্ষণ চুপ করে রইল৷ তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকে লক্ষ করছিলেন বিজন রায়চৌধুরী৷

—ওপর থেকে তো সব বোঝা যায় না৷ কারও নিন্দা আমি করতে পছন্দ করি না৷ সত্যি বলতে কি অনিলকে আমার একটু অস্বাভাবিক মনে হয়েছে৷ ক্রুয়েল, লোভী, নৈতিকতার কোনও বালাই নেই৷ ন্যায়, অন্যায়, বিবেক বোধের কোনও অনুভূতি নেই৷ শুনেছি রহস্যজনক ভাবে তার মৃত্যু হয়েছে৷ আই হ্যাভ নো সিমপ্যাথি৷ হি হ্যাজ বিন পেইড উইথ হিজ ওন কয়েন৷ জানেন, নিজেই বলেছে নিরীহ কুকুরদের ওপর অত্যাচার করে ওর নাকি এক রকম উল্লাস হ’ত৷ রহস্য, বিজ্ঞানে যার ব্যাখ্যা মেলে না, অলৌকিক ঘটনা— এসব খুব বলে বেড়াত৷ এখন তার নিজের মৃত্যুই রহস্যময় হয়ে রইল৷

—আচ্ছা বিশ্বনাথবাবু, প্রমোদনগরে অনিলের বাড়িতে আপনি কখনও গিয়েছেন?

—হ্যাঁ, অনিলের সঙ্গেই একবার গিয়েছিলাম৷ একটা জমি কেনার ব্যাপারে আমাকে প্রায় জোর করে নিয়ে গিয়েছিল৷ ওই একবারই৷

—বিশ্বনাথবাবু, আপনার ফোনটা এক মিনিটের জন্য দেবেন প্লিজ? আমার ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছে৷ হাসপাতালে এখনই একটা জরুরি কথা জিজ্ঞেস করতে হবে৷

বিশ্বনাথ তাঁর ফোন এগিয়ে দিল৷ বিজন রায়চৌধুরী নম্বর টিপতে টিপতে বাইরের বারান্দায় গিয়ে কথা বলে বিশ্বনাথকে ফোন ফেরত দিলেন৷

—হাসপাতাল থেকে কোনও খবর পেলেন স্যার?

—নাঃ, সে রকম কোনও পেশেন্টের খবর নেই৷ সত্যজিৎ, খবর নাও তো এখানে ভাইরোলজিস্ট কেউ আছেন কিনা৷

সত্যজিতের মোবাইল বেজে উঠল৷ কল রিসিভ করে সত্যজিৎ বাইরে গেল৷ দূর থেকেও তার উত্তেজিত গলা শোনা যাচ্ছিল৷ প্রায় দৌড়ে ঘরে ঢুকল সত্যজিৎ৷

—স্যার, থানা থেকে বড়োবাবু ফোন করেছিলেন৷ আমি তো আপনার কথামতো হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, ছোটোবড়ো সমস্ত নার্সিংহোমে খবর দিয়ে রেখেছিলাম জলাতঙ্কের পেশেন্ট এলেই যেন থানায় খবর দেয়৷ পেশেন্ট এবং পেশেন্ট পার্টিকে যেন কোনও ভাবেই ছেড়ে না দেয়৷ মেডিকেল কলেজ থেকে ফোন এসেছিল৷ জেনুইন ডগ বাইটের কেস নিয়ে একজন এসেছে৷ সঙ্গে তার ছোটোবোন৷ রাত প্রায় দু’টো প্রচণ্ড শব্দে এবং প্রচণ্ড গতিতে বাইক চালিয়ে ওরা যাচ্ছিল৷ জানেন তো স্যার, মোড়ের কুকুরগুলো বুলেটের আওয়াজ একদম পছন্দ করে না৷ কুকুরগুলো অত রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বিরক্ত হয়ে দৌড়ে গিয়ে যে মহিলা চালাচ্ছিল, তার জিন্সের ওপর দিয়ে কামড়েছে৷

—পেশেন্টের নাম কি মাধবী মণ্ডল? যে অ্যাডমিট করিয়েছে তার নামঠিকানা এখনই জিজ্ঞেস করো৷

—হ্যাঁ স্যার, মাধবী মণ্ডল৷ সঙ্গে ছিল মালতী মণ্ডল৷ গোপালের মোড়, জগৎপুর৷ আর পেশেন্টের নখের ভেতরে মাটির গুঁড়ো পাওয়া গেছে৷

—ঠিকানা ফলস্ হতে পারে৷ সেটা পরে বের করা যাবে৷ তুমি এখনই ফোন করো মালতীকে ভ্যাকসিন দেবার জন্য৷ মালতীকে থানায় আনতে হবে৷ ওর সঙ্গে কথা বলা ভীষণ দরকার৷ চলো আজ বড়োবাবুর সঙ্গে একটু আলাপ করে আসি৷ ওদের দুজনকেই পুলিশ কাস্টডিতে নিয়ে নাও৷ সাবধান, মাধবী আবার পালাতে পারে৷

নয়

থানাটা বেশ আধুনিক৷ হঠাৎ মনে হয় কর্পোরেট কোনও অফিস৷ ফুলের টব দিয়ে, ওয়াল হ্যাংগিং দিয়ে, সুন্দর ছবি দিয়ে— মনে হয় না এখানে আসতে সাধারণ মানুষের বুকে কেঁপে ওঠে৷ এমনকি একটা ছোটো কন্ফারেন্স রুম পর্যন্ত রয়েছে৷

এখন সেখানে বসে রয়েছে বিজন রায়চৌধুরী, এস আই সত্যজিৎ সামন্ত, এ এস আই দীপঙ্কর বাগচি, সার্কেল ইন্সপেক্টর হরদেও সিং৷ একটু দূরে একটা টুলে বসে আছে মালতী মণ্ডল৷ বিশ্বনাথ সেনকে হরদেও সিং ফোন করছে— হ্যালো, বিশ্বনাথবাবু? হ্যাঁ, আমি সি আই বলছি৷ পাঁচ মিনিটের জন্য একবার থানায় আসুন না৷ আপনার তো সুকটার আছে৷ জাস্ট দু’একটা কথা জিজ্ঞেস করব৷ হ্যাঁ, অনিল মোহান্ত খুনের ব্যাপারে৷ হ্যাঁ, মনে হচ্ছে ওঁকে খুন করা হয়েছে৷ কিন্তু কীভাবে আর কে করেছে সেটা আমরা জানি না৷ পাঁচ মিনিটেই ছেড়ে দেব আপনাকে৷ না না, ফোনে বলা যাবে না৷

বিশ্বনাথ সেনকে একজন কনস্টেবল এই ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেল৷

—বসুন৷ একটা খালি চেয়ার দেখিয়ে দিলেন সি আই সাহেব৷

—বলুন, আমার কাছে কী জানতে চান? সবই তো বলেছি৷ অনিল মোহান্ত তো আমাকে ঝামেলায় ফেলে দিল৷

—হ্যাঁ, আমরাও খুব ঝামেলায় পড়েছি৷ আমাদের তো চাকরি নিয়ে টানাটানি৷ আচ্ছা বিশ্বনাথবাবু, মাধবী মণ্ডলের বোন মালতীকে চেনেন?

—নাম শুনেছি, দেখিনি কখনও৷

—আপনি কখনও প্রমোদপুরে গিয়েছেন, অনিল মোহান্তর বাড়ি?

—আগেই বলেছি একটা জমি দেখার ব্যাপারে একবারই গিয়েছিলাম৷ তারপর আর কোনও দিন যাইনি৷

—বিজনবাবু, আপনার কিছু জানার থাকলে জিজ্ঞেস করে নিন৷ হরদেও সিং কথা বলে টেবিলের নীচে এক বোতাম টিপলেন৷ কর্কশ নয়, খুব সুরেলা আওয়াজে ঘণ্টি বাজল৷ একজন কনেস্টবল দরজা দিয়ে মুখ বাড়াল৷

—শিবেন, ক্যান্টিন থেকে ছ’কাপ চা নিয়ে এসো৷ ভালো দার্জিলিং লিফ দিয়ে বানাতে বলবে৷ স্পেশাল গেস্ট আছে৷ আর, তুমিও এক কাপ খেয়ে নিও৷ সবগুলোয় চিনি কম হবে৷

—আচ্ছা বিশ্বনাথবাবু, ক’কাঠা জমি নিয়েছেন আপনি? কত করে পড়ল?

—না, জমি আমার পছন্দ হয়নি৷ জায়গা অনুযায়ী দাম অনেক বেশি বলেছিল৷ নিইনি৷ বিজন রায়চৌধুরীর প্রশ্ণের উত্তরে বিশ্বনাথ বলল৷

—আচ্ছা, আপনি মালতী মণ্ডলকে চেনেন না? পেছন ফিরে দরজার পাশে ওই মহিলাকে দেখুন তো?

চমকে পেছনে তাকাল বিশ্বনাথ৷ দরজার পাশে টুলে বসে আছে বেশ সুন্দরী একজন মহিলা৷ তার শরীরে স্বাস্থ্যের আয়োজন বড়ো বেশি৷ চোখ ফিরিয়ে নিল বিশ্বনাথ৷ এ মুখ সে আগে একবার দেখেছে৷ 

—মালতী, তুমি ভালো করে দেখ তো এই ভদ্রলোককে আগে কোথাও দেখেছ কিনা! ভালো করে দেখবে৷ তোমার কথার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে৷

বিজনবাবুর কথা শুনে মালতী সরাসরি বিশ্বনাথ সেনের দিকে তাকাল৷ ভালো করে ওকে লক্ষ করল৷ তাঁর চোখে বিচিত্র ভাব খেলা করছে৷

—হ্যাঁ, দেখেছি৷ কিছুদিন আগেই জমি দেখতে গিয়েছিলেন৷ দাদাবাবুর কাছে শুনেছি ওঁদের অফিসের বড়ো অফিসার৷ কিন্তু জমি উনি কেনেননি৷ জমি দেখতেও যাননি৷ রাত হয়ে গিয়েছিল৷ উনি ফিরে যান৷ দাদাবাবু চা খাওয়ার কথা বলেছিল, উনি অপেক্ষা করেননি৷

—এবার খুব ভালো করে চিন্তা করে বলবে, সেদিন বাদে আর কোনও দিন তুমি বিশ্বনাথবাবুকে দেখেছ?

বিজন রায়চৌধুরী তাকিয়ে রয়েছেন বিশ্বনাথ সেনের মুখের দিকে, বিশ্বনাথ তাকিয়ে আছে মালতী মণ্ডলের চোখের দিকে৷ অন্য সবাই মালতীর উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা করছে৷ ঘরে অদ্ভুত এক শীতল নৈঃশব্দ্য৷

—হ্যাঁ, দেখেছি৷ যেদিন সকালে দাদাবাবু ‘শরীর ভালো লাগছে না’ বলে নতুন ফ্ল্যাটে চলে গেলেন, তার দু’দিন আগে রাত আটটা নাগাদ বাইরে কারও পায়ের শব্দ পেয়েছিলাম আমি৷ দাদাবাবুর নয়, সে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি৷ একটু ভয় পেয়েছিলাম৷ বাড়িতে একা রয়েছি, দাদাবাবু আজ বাইক নিয়ে অফিসে বেরোয়নি৷ নতুন মোটর সাইকেলটা বাইরে রয়েছে৷ আমি খুব সাবধানে জানলার পর্দা একটু সরিয়ে দেখলাম সেই দাদাবাবুর অফিসের অফিসার বিশ্বনাথবাবু বাইকের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন৷

—তুমি একদম শিওর লোকটা বিশ্বনাথবাবুই ছিলেন? অন্ধকার ছিল না?

—হ্যাঁ, আমি শিওর৷ অন্ধকার ছিল, কিন্তু রাতে কুয়োর পাড়ে সারারাত একটা আলো জ্বলে৷ তার আভায় আমি চিনতে পেরেছিলাম৷ এই পোশাকই ছিল৷ সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট৷

—তারপর?

—তারপর উনি বাইরে চলে গেলেন৷ একটু বাদেই সুকটারের আওয়াজ হতে আমি শিওর হয়ে যাই এ লোকটাই জমির খোঁজে এসেছিল, কিন্তু জমি কেনার ব্যাপারে কোনও গরজ ছিল না৷ রাতে দাদাবাবু এসে বাইক তুলল৷ গাঁদাফুলের গাছ থেকে পাতা তুলে ডলে ডানহাতের মাথায় লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে নিল৷ আমি জিজ্ঞেস করিনি৷

—একটা কথা মালতী, লজ্জা না করে স্পষ্ট উত্তর দেবে৷ তুমি কি রাত বেশি হয়ে গেলে অনিলের কাছে থেকে যেতে? আর, অনিলের মোবাইল তোমার কাছে থাকলে থানায় জমা দেবে৷ প্রচুর ক্যাশ রয়েছে তোমাদের কাছে৷ আমরা সেসব বের করে নেব৷ কিন্তু তুমি সেটা নিজে দিলে ভালো হ’ত৷

মাথা নিচু করে বসে রইল মালতী মণ্ডল৷

—আঃ, খুব ভালো চা খাওয়ালেন মিস্টার সিং৷ আমি অবশ্য হ্যাপি ভ্যালির সেকেন্ড ফ্লাশটা বেশি পছন্দ করি৷ এটাও বেশ ভালো৷ সত্যজিৎ, তুমি বিশ্বনাথবাবুকে অনিল মোহান্তকে খুনের চার্জে গ্রেপ্তার করতে পারো৷

—কেন? আমি কীভাবে অনিলকে খুন করলাম? ওকে খুন করে আমার কী লাভ?

—কীভাবে খুন করেছেন, সেটা জানতে পারলাম এখনই৷ কিন্তু কেন করেছেন, সেটা আপনার নিজের মুখে শুনতে চাই৷

বিজন রায়চৌধুরীর কথা শেষ হলে সবাই অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল৷ ওভারশিয়ার বিশ্বনাথ সেন তাঁর অফিসের সাবস্টাফকে খুন করেছে— অবিশ্বাস্য ব্যাপার৷ শরীরে কোথাও কোনও চিহ্ণ নেই, অথচ পাগলা কুকুরের কামড়ের সমস্ত লক্ষণ নিয়ে অনিল মোহান্ত হাসপাতালে ভর্তি হ’ল এবং মরে গেল৷ স্থানীয় চিকিৎসক মহলে এটা বেশ চর্চার বিষয় হয়েছিল৷ খবরের কাগজে নিউজও হয়েছিল৷

—আপনাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে৷ আমি কীভাবে খুন করব?

—সেদিন আপনার ফোনটা নিয়েছিলাম হাসপাতালে ফোন করার জন্য, ওটা আমার বাহানা ছিল৷ বারান্দায় গিয়ে আপনার কললিস্ট চেক করেছি৷ দেখেছি গত একমাস ধরে আপনি গুগল্-এ শুধু ভাইরোলজির সাইটগুলো সার্চ করেছেন৷ স্পেশালি নিউরোট্রপির ভাইরাস নিয়ে৷ তারপর প্ল্যান সাজালেন৷ জমি দেখার বাহানায় অনিলের বাড়ি চিনে এলেন৷ এটাও জানলেন অনিল কোনও কোনও দিন বাইক বাড়িতে রেখে অফিসে আসে৷ বাইক অনেক রাত পর্যন্ত বাইরেই পড়ে থাকে৷ এই সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করলেন আপনি৷ কোনও কারণে অনিলের প্রতি তীব্র ঘৃণা ছিল আপনার মনে৷ সেই ঘৃণাই আপনার মনে ঘাতকের জন্ম দিয়েছে৷

—হ্যাঁ, তারপর বলুন৷

—গল্প তো ভালোই বানিয়েছেন?

বিশ্বনাথবাবুর কথা শুনে মৃদু হাসলেন বিজনবাবু৷

—অতি বাস্তব গল্প৷ আশ্চর্য আপনার বুদ্ধি! সত্যজিৎ আমার কাছে না এলে এটা আনসলভ্ড মিস্ট্রি হয়ে থাকত৷ আপনি তো জানতেন শরীরে জলাতঙ্কের বিষ ঢোকার দু’দিন থেকে দশদিনের মধ্যে লক্ষণ প্রকট হয়ে ওঠে৷ এমনকি, অনেক সময় এক বছর পরেও রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়৷ লক্ষণ প্রকাশ পেলে লস্ট কেস৷

—আচ্ছা, আমাকে দোষী সাব্যস্ত করার আগে কীভাবে খুনটা করেছি, একটু ব্যাখ্যা করবেন?

—অবশ্যই, কোথাও ভুল করে থাকলে ধরিয়ে দেবেন৷ আপনি কুকুর এত ভালোবাসেন যে, পুরনো একটা ক্ষতে আঘাত লাগায় মানুষ খুন করলেন৷ বছর পাঁচেক আগে আপনার অত্যন্ত আদরের ‘জলি’ খোলা গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল৷ আপনি ওকে ধরার জন্য শিকল হাতে নিয়ে দৌড়চ্ছিলেন৷ ডাকছিলেন আয় জলি, জলি দাঁড়া৷ জলি জিভ বের করে হাঁপাচ্ছিল৷ আর ওদের লেজ তো দেশি কুকুরদের মতো ঘোরানো থাকে না৷ ঝোলানোই থাকে৷ মানুষ খুব ভালোবাসত জলি৷ লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে কোলে উঠতে চাইত৷ আদর কেড়ে নিত৷ তো জলি যখন পার্কে ঢুকে পড়েছে, কিছু মানুষ ভুল বুঝে মনে করেছে পাগলা কুকুর৷ মেয়েরা বাচ্চাদের নিয়ে দৌড়চ্ছে, চিৎকার করে সাবধান করছে, আর কিছু উৎসাহী বীর যুবক ইটের আর পাথরের টুকরো ছঁুড়ে আপনার চোখের সামনেই ছোট্ট কুকুরটাকে মেরে ফেলল৷ খুব আপসেট হয়ে পড়েছিলেন৷  আপনার ভেট ডক্টর রহমান আর প্রতিবেশীরা সবই জানে৷ ওরাও খুব  দুঃখ পেয়েছিল৷

বিজন রায়চৌধুরীর কথা সবাই মন্ত্রমুগ্দের মতো শুনছে৷ একটু বিশ্রাম দিতেই সি আই সাহেব আবার বোতাম টিপে চা পকোড়ার কথা বলে দিলেন৷ সত্যজিৎ অবাক হচ্ছিল৷ স্যার এত খবর জোগাড় করেছে, তারা এসব কিছু ভাবেইনি৷

—আমি এক মিনিটের জন্য পাশের ঘর থেকে আসছি৷

সার্কেল ইন্সপেক্টর কোণের দিকের একটা দরজা খুলে ভেতরে গেলেন৷ হাসলেন বিজনবাবু৷ তারও নেশা পেয়েছে৷ উঠে একটু দূরে গিয়ে পকেট থেকে কৌটো বের করে একটিপ নস্যি নিলেন৷ অ্যান্টি চেম্বার থেকে হালকা সিগারেটের গন্ধ আসছে৷ বিশ্বনাথ মাথা নিচু করে বসে আছে৷ সত্যজিৎ আর দীপঙ্কর নিচু স্বরে নিজেদের ভেতরে কথা বলছে৷

—এবার আসল কথায় আসি৷ খুব সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলাম৷ বুঝতে পারছি অনিল মোহান্তর শরীরে কোনোভাবে ভাইরাইসটা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ আর ভাইরাস তো পাগলা কুকুরের লালা ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাবে না৷ তখনই খবর পেলাম বিশ্বনাথবাবুর বাড়ির সামনে একটা পাগলা কুকুরকে পিটিয়ে মেরেছে পাড়ার ছেলেরা৷ অন্ধকারে একটু আলো পেলাম৷ একটু থামলেন বিজনবাবু৷

কিন্তু ‘মোডাস অপারেন্ডি’? কীভাবে খুনটা হয়েছে৷ সেটাও বিশ্বনাথবাবু নিজের অজান্তে বলে দিয়েছেন৷ উনি সেতার বাজান৷ আমার বাড়িতে যেদিন বিশ্বনাথ সেন এলেন, বলছিলেন সেতারের তারের মাথা ফুটে গেছে আঙুলের মাথায়৷ ব্যথা আছে৷ আমিও একসময় সেতার বাজাতাম৷ আমি জানি এই তারগুলো খুব সরু অথচ প্রচণ্ড শক্ত হয়৷ আর, মাথা এত তীক্ষ্ন এবং ছোটো হয়, ফুটে গেলে একটু রক্ত বেরোয়৷ ব্যস্, তারপর আর কোনও চিহ্ণ থাকে না৷ চার-পাঁচদিন পরে তো কিছুই বোঝা যায় না৷ সবচেয়ে সরু হ’ল ডবল জিরো নাম্বারের তার৷ এর মাথা দিয়ে খোঁচা লাগলে চিহ্ণ প্রায় খঁুজেই পাওয়া যায় না৷ এক সপ্তাহ বাদে তো কিছুই বোঝা যাবে না৷ বিশ্বনাথবাবু সেই তারের মাথা খুব ছোটো মাপে, প্রায় হাফ সেমি বা তারও কম মাপে কুঁচি কুঁচি করে কেটেছেন৷ এক টুকরো তুলোর মধ্যে সেগুলো রেখে বাড়ির সামনে থেকে পাগলা কুকুরের লালা সংগ্রহ করেছিলেন, সেই লালা দিয়ে তুলো ভিজিয়েছেন৷ অবশ্যই খুব সাবধানে, দু’হাতে পুরু গ্লাভস্পরে৷ তারপর সেই তুলো টেপ দিয়ে আটকে দিলেন৷

—কোথায়? প্রায় দমবন্ধ অবস্থায় সত্যজিৎ জিজ্ঞেস করল৷

—সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ণ৷ অসম্ভব বুদ্ধি প্রয়োগ করেছিলেন বিশ্বনাথ সেন, কিন্তু…

—কিন্তু কী? দীপঙ্কর জানতে চাইল৷ সার্কেল ইন্সপেক্টর হরিদেও সিং অবাক হয়ে বিশ্বনাথবাবুর দিকে তাকিয়ে আছেন৷ বিশ্বনাথ আর বিজন রায়চৌধুরীপরস্পরের্ দিকে তাকিয়ে রয়েছে৷ দুজনেরই চোখের দৃষ্টি যেন খোলা তরোয়াল৷ কাটাকুটি খেলছে৷ ঝকমকে, ধারালো৷

—কোথায় আটকে দিল?

—সেটাই তো লাখ টাকার প্রশ্ণ সি আই সাহেব৷ বিশ্বনাথ ভাবেনি জানালার পর্দা সরিয়ে মালতী ওকে দেখে ফেলবে৷ বিশ্বনাথ ভাবেনি ওর ফোনের কললিস্ট থেকে আমি জানতে পারব উনিশ তারিখে সে অনিলের সঙ্গে কথা বলেছে৷ সম্ভবত জানতে চেয়েছিল সেদিন আটটা নাগাদ সে বাড়ি থাকবে কিনা! অনিল জানিয়েছিল জমির ব্যাপারে সে শহরের বাইরে যাবে৷ ফিরতে রাত হবে৷ ব্যস্, বিশ্বনাথ প্ল্যান সাজিয়ে ফেলল৷ বিষাক্ত লালা সংগ্রহ করা ছিল, সেই শিশি ফ্লাক্সে নিয়ে গ্লাভস্ পরে, তুলো আর ব্ল্যাকটেপ নিয়ে রওনা হ’ল প্রমোদপুরে৷ সেটা তো মালতী দেখেছে৷ কিন্তু মালতী জানে না তখন সেই মৃত্যুফাঁদ বিশ্বনাথের ডানদিকের হ্যান্ডেলের গ্রিপ কভারের নীচের দিকে আটকে দিয়েছে বিশ্বনাথ৷ অন্ধকার ছিল, অমাবস্যা৷ পরের দিন সমাধান ছিল, পাঁচ অক্ষরে ‘নষ্টেন্দুকলা’৷ সরি, অন্যকথা বলে ফেলেছি৷ অনিল রাতে ফিরে হ্যান্ডেল ধরে গ্যারেজে তুলেছে৷ একটু খোঁচা লেগেছিল৷ অত আর খঁুটিয়ে দেখেনি৷ গাঁদাফুলের পাতা ডলে আঙুলের মাথায় বেঁধে রেখেছিল৷ তারপর ব্যান্ডেজ খুলে গেছে, সূক্ষ্মদাগ মিলিয়ে গেছে৷ শুধু শুকনো গাঁদাপাতার কালচে হয়ে আসা গুঁড়োগুলো নখের ভেতরে জমে ছিল৷ হাসপাতালে নখের ভেতরে সেটা পেলেও গুরুত্ব দেয়নি৷ পরে আমি অনুরোধ করায় রিপোর্ট আবার ভালো করে পড়ে আমায় শুনিয়েছে৷

সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল৷ কী নিপুণ দক্ষতায় মৃত্যুর ঘঁুটি সাজিয়েছিল বিশ্বনাথ সেন! এই কেস অমীমাংসিত হিসেবে ক্লোজড্ হয়ে যেত, বিজন রায়চৌধুরী জড়িয়ে না পড়লে৷

সবাই অবাক হয়ে দেখল বিশ্বনাথ সেন হাসছে৷ হঠাৎ শকে অনেক সময় মানুষ পাগল হয়ে যায়৷ বিশ্বনাথের সেরকম কিছু হ’ল নাকি!

—কিছু মনে করবেন না বিজনবাবু, আপনি অঙ্কের টিচার ছিলেন, কিন্তু ভাইরোলজি  সম্পর্কে আপনি কিছুই জানেন না৷ খুব সুন্দর একটা গল্প বানিয়েছেন৷ হ্যাঁ, আমি সে রাতে অনিলের বাড়িতে গিয়েছিলাম৷ আমি জানতাম অনিল সুদের ব্যবসা করে৷ আমার হঠাৎ খুব টাকার দরকার ছিল৷ ভেবেছিলাম ওর থেকেই লোন নেব৷ কিন্তু ওর বাড়িতে  গিয়ে ডিসিশন পাল্টে ফেললাম৷ না, এ-কথা অফিসে চাউর হ’লে আমার পক্ষে লজ্জার ব্যাপার৷ অনিলকে ডাকতে গিয়েও ডাকিনি৷ ফিরে এসেছি৷ আর, শুনুন স্যার, হোস্টের সেলের বাইরে এই ভাইরাসকে প্রিজার্ভ করতে হ’লে মাইনাস তিরিশ ডিগ্রি থেকে মাইনাস আশি ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখতে হয়৷ তো আমি একটা ফ্রিজার সঙ্গে নিয়ে রাত্রিবেলা অনিলের বাড়ি গিয়েছিলাম বলতে চান? আপনি ভাইরাসের ‘ভ’-ও জানেন না৷

ঘর নিস্তব্ধ৷ সবাই বিশ্বনাথের কথা শুনে কেমন যেন হতাশ হয়ে পড়েছে মনে হ’ল৷ একটা আলপিন পড়লেও এখন হাতুড়ি পড়ার শব্দ শুনবে সবাই৷ হাসছে বিশ্বনাথ৷ সবাই এখন বিজন রায়চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে৷

—ঠিকই বলেছেন৷ আমি ভাইরাসের ‘ভ’-ও জানি না৷ কিন্তু লিকুইড নাইট্রোজেন বাLN2 সম্পর্কে কিছুটা জানি৷ মালতী, ভালো করে মনে করে দেখো তো, সেদিন রাতে এই দাদাবাবুর কাছে আর কিছু ছিল কিনা, নাকি খালি হাতে ছিলেন!

—হ্যাঁ ছিল৷ প্রথমে অন্ধকারের জন্য আমি ভালো বুঝতে পারিনি৷ পরে যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন ওঁর কাঁধে একটা ব্যাগ দেখেছি৷ ব্যাগ ঠিক নয়, ফ্লাক্স জাতীয়৷ বেল্টের সঙ্গে কাঁধে ঝুলছিল৷ উনি বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় দাদাবাবু এসেছিলেন৷

—হ্যাঁ, জানি৷ এক লিটার লিকুইড নাইট্রোজেন৷

—হ্যাঁ, আমিই অনিল মোহান্তকে ছক কষে খুন করেছি৷ অনিল মোহান্তর মতো মানুষদের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার নেই৷ আপনাদের আইন ওর কিছুই করতে পারত না৷ কী শাস্তি হয়, যাঁরা কালীপুজোর রাতে বাজি ফাটিয়ে যত পশুপাখি আর অসুস্থ মানুষকে আরও অসুস্থ করে! কী শাস্তি হয় তাদের, যারা কুকুরের লেজে তারাবাজি বেঁধে নিষ্ঠুর উল্লাস করে! বলুন, কী শাস্তি দিতে পারেন আপনি, যাঁরা দিব্যি সুস্থ কুকুরকে পাগল বানিয়ে পাথর ছঁুড়ে মেরে ফেলতে পারে! আমি মনে করি না এরা এই সমাজে বেঁচে থাকার যোগ্য৷ পৃথিবী সবার জন্য৷ শুধুমাত্র মানুষের জন্য নয়৷ আমি যখন থেকে বুঝেছি এই লোকটা অর্থের পিশাচ, চূড়ান্ত ভোগী, ন্যায়নীতিবিবেকহীন, কুকুরের ওপর অত্যাচার করতে ভালোবাসে, আর যত অলৌকিক, রহস্যময় গল্প বিশ্বাস করে— সেদিনই আমি আমার দিক থেকে ওকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছি৷ এমন মৃত্যু, সেটাও চিরদিন একটা রহস্যময় কাহিনী হয়ে থাকবে৷ মাকড়শার মতো জাল বুনে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে গেছি৷ ঘৃণা করতাম ওকে৷ জন্তুজানোয়ারদের যাঁরা কষ্ট দিয়ে বীভৎস আনন্দ উপভোগ করে, তাদের প্রত্যেককে ঘেন্না করি৷ জলি, ওফ্ জলি…

সি আই সাহেব তাঁর মোবাইলের ভয়েস রেকর্ডার অফ করলেন৷ সত্যজিৎও রেকর্ড করছিল, সে-ও বন্ধ করল৷

—ঘেন্না করি, ঘেন্না করি৷ ফিসফিস করে বলছিল বিশ্বনাথ৷ ফঁুপিয়ে কাঁদছিল৷ নিজের জন্য নয়, সন্তানের মতো পোষ্যদের জন্য৷ কতদিন ধরে রেবিজ ভাইরাস নিয়ে পড়াশোনা  করেছি৷ ওদের আর এন এ স্ট্রাকচার, ওদের স্বভাবচরিত্র, কীভাবে প্রিজার্ভ করা যায়— ধীরে ধীরে সব জেনেছি৷ সেতারের চিকারি বা তরফের তার ছিঁড়ে গেলে কাটার দিয়ে খুব সূক্ষ্ম কুঁচি কুঁচি টুকরো করে জমিয়ে রাখতাম অনিলের জন্য৷ খুব ভালো ইনসুলেটেড দামি ফ্লাস্ক কিনেছিলাম৷ দরকার ছিল না, ওরা যে সিলিন্ডার দিয়েছিল, সেখানেই আমার ছোটো কন্টেনার রেখেছি৷ শেষ মুহূর্তে কন্টেনার বের করে প্রথমে কিছুটা তুলোয় স্প্রে করে নিয়েছি৷ তারপর খুব তাড়াতাড়ি ছোটো ছোটো ধারালো তারের মাথাগুলো তুলোর ভেতরে রেখে ব্ল্যাকটেপ দিয়ে গ্রিপ কভারের নীচের দিকে সেঁটে দিয়েছি৷

—জানি সব৷ দু’একটা খটকা ছিল, এখন সব পরিষ্কার হয়ে গেছে৷ সত্যজিৎ, এই কাগজটা রাখো৷ লিকুইড নাইট্রোজেন গ্যাসের রসিদের ফোটোকপি৷ মনে নেই, সি আই সাহেবকে দিয়ে নিউ দিল্লির মালব্যনগর থানায় ফোন করা হ’ল! ওরা সব ডিটেইলস্ পাঠিয়ে দিল! হ্যাঁ বিশ্বনাথবাবু, আপনার ফোন সার্চ করে সবই পাওয়া গেছে৷ রেবিজ ভাইরাস নিয়ে অনুসন্ধান, লিকুইড নাইট্রোজেনের খোঁজ৷ অ্যান্টিডোটের ব্যবহার, রোগীর আচার-ব্যবহার, কন্টেনার ব্যবহারের প্রসেস— আপনি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে খোঁজ নিয়েছেন৷ তারপর মৃত্যুবাণ নিজের হাতে বানিয়েছেন৷ ভেবেছিলেন অনিল মোহান্তর মৃত্যুই রহস্যময় হয়ে থাকবে৷ কিন্তু হোরাশিও, দেয়ার আর মোর থিংস্ ব্লা ব্লা ব্লা… ৷ আপনার কষ্টটা বুঝতে পেরেছি৷ সত্যজিৎ আমার কাজ শেষ৷ এখন মালতী আর বিশ্বনাথ সেন তোমাদের হাতে৷ তোমাদের কাজ তোমরা করো৷ আমি আসি৷ এই কেসে কোথাও তোমাদের কোনও সংশয় থাকলে বলো, আমি ক্লিয়ার করে দেব৷ আর, অটোপ্সি রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা ছিল অ্যাকিউট এনসেফেলাইটিস৷ নিউরোট্রপিক ভাইরাসে তাই হয়৷ মালতী শোনো, তোমাদের কাছে প্রচুর টাকা রয়েছে৷ অস্বীকার করেছ, কিন্তু জানো তো টাকা মাটি মাটি টাকা৷ এটা আমরা উদ্ধার করতে পারব৷

—মানে স্যার, আপনি জানেন টাকা কোথায়?

—জানি৷ মাধবীর ঘর থেকে সাউন্ডবক্সের তার মাটির তলা দিয়ে কবরখানার দিকে গেছে৷ ওখানে যে সাউন্ডবক্স পাবে, তার কাছাকাছি কোনও পুরনো গর্ত পাবে৷ নতুন মাটি দেখলেই বুঝতে পারবে৷ অনিলের মৃত্যুর খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা সুটকেসে সব টাকা ভরে সেই গর্তে রেখে এসেছিল ওরা দু’বোন মিলে৷ মাধবীর ভেতরের ঘরে কোদাল দেখেই সন্দেহ হয়েছিল৷ তখনও মাটি লেগে ছিল৷ ভালো করে পরীক্ষা করলে এখনও হয়তো মালতীর নখের ভেতরে মাটি পাবে৷ আর মাধবীর নখের ভেতরে কালো মাটি পাওয়া গেছে, সেটা মেডিকেল কলেজের রিপোর্টে আছে৷

—আর অনিল মোহান্ত নখের কালচে সবুজ গুঁড়ো হচ্ছে শুকিয়ে যাওয়া গাঁদাপাতা, তাইতো স্যার?

—ইয়েস৷ মাথা খুলছে তাহ’লে৷ আর কিছু?

—বিজনবাবু, আর এক কাপ চা খেয়ে যান৷

—খাব সি আই সাহেব৷ আগে একটিপ নস্যি নিতে দিন৷ সত্যজিৎ, বিশ্বনাথবাবুর মোবাইল থেকে উনি গুগলে কী কী সার্চ করেছেন, সেগুলোর স্ক্রিনশট নিয়ে রাখো৷ উনিশ তারিখের কললিস্টও৷ এখানে নস্যি নিলে কারও অসুবিধা নেই তো?

—বিজনবাবু, আমি, সত্যজিৎ আর দীপঙ্কর মিলে ডিপার্টমেন্টের তরফ থেকে আপনাকে একটা স্যালুট জানাতে চাই৷ কারও অসুবিধা নেই তো?

মালতীও একটু বিষাদজড়ানো হাসি হাসল৷

–স্যার, মোটামুটি ক্লিয়ার হয়েছে৷ খুনের মোটিভ কিন্তু আমার কাছে খুব জোরালো মনে হল না৷

—সত্যজিৎ, কার যে হৃদয়ের কোথায় বেদনা জমে থাকে, আমরা ওপর থেকে তার কতটুকু বুঝতে পারি! প্রত্যেকের বুকের ভেতরে একটা হিমশৈল থাকে৷ আমরা শুধু তার জেগে থাকা অংশ দেখতে পাই৷ টিপ অফ দা আইসবার্গ৷ মানুষের মন এক রহস্যময় জগৎ৷ কখনও আপাত শান্ত মানুষের বুকের গভীরে সেই হিমশৈল জেগে ওঠে৷ মানব -সভ্যতার অহংকারী টাইটানিক ডুবে যায়৷

—স্যার, শেষ দিকটায় এসে আমার কেমন গুলিয়ে গেল৷ লিকুইড নাইট্রোজেন কি উনি আগেই কিনে রেখেছিলেন? 

—খুব ঠাণ্ডা মাথায় প্ল্যান সাজিয়েছিল বিশ্বনাথ সেন৷ যেদিন সে শুনেছে অনিল মোহান্ত কুকুরের ওপর অত্যাচার করতে ভালোবাসে, সেদিন থেকেই তীব্র ঘৃণা মিশিয়ে বিশ্বনাথের মৃত্যুবাণ তৈরির কাজ শুরু হয়৷ ভাইরোলজি নিয়ে পড়াশোনা, বিশেষ করে রেবিজ ভাইরাস নিয়ে৷ কুকুরের লালায়, কুকুর যদি পাগল হয়— জলাতঙ্কের ভাইরাস থাকবে৷ কিন্তু সেটা বাইরে বেশিক্ষণ বাঁচে না৷ তখন দরকার পড়ল লালা প্রিজার্ভ করার জন্য লিকুইড নাইট্রোজেনের কনটেনার৷ তারপর সেটা ব্যবহারের পদ্ধতি ইউ টিউবে বারে বারে দেখে রপ্ত করেছেন৷ উনিশ তারিখ রাতে অনিল একটু দেরি করে ফিরবে, ফোন করে জেনে নিয়েছিল বিশ্বনাথ৷ তারপর এক্সপেরিমেন্ট করতে বেরল কনটেনারের ভেতরে লিকুইড নাইট্রোজেন, তার ভেতরে রেবিজ ভাইরাসের শিশি৷ একটা পাতলা তুলোর প্যাডে তারের কুঁচি, একটা ব্ল্যাকটেপ, একটা ব্লেড৷ তুলোর প্যাডে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লালা ঢেলে খুব দ্রুত বাইকের গ্রিপ কভারের নীচে সেঁটে দিয়েছিল৷ ব্যস্, কাজ কমপ্লিট৷ বিশ্বনাথবাবুর কপাল ভালো যে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অনিল বাড়িতে ঢুকে প্রথমে বাইকের হ্যান্ডেলে হাত দিয়েছে বাইক ঘরে তোলার জন্য৷ আর সামান্য দেরি হলেই ভাইরাস কাজ করত না৷ কী বলবে এটাকে? ভাগ্য সহায় হয়েছে, না বিপক্ষে গেছে?

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সবাই৷ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হরদেও সিং কথা বললেন৷

—আসলে জানেন কী মিস্টার রায়চৌধুরী মানুষের লোভ, মানুষের ঘৃণা— এসব তো পাল্টায়নি৷ সোসাইটির, সিভিলাইজেশনের ঘুণপোকা এগুলোই৷

—একদম৷ যতই সভ্য হই, মূল সেই ষষ্ঠরিপু এক রয়ে গেছে৷ বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি মানুষের কাম ক্রোধ লোভ মোহ মদ মাৎসর্যের৷ এবার সত্যি উঠব৷

—দীপঙ্কর, স্যারকে বাড়িতে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করো৷

—সত্যজিৎ, দীপঙ্করকে নিয়ে একদিন বাড়িতে এসো৷ মিনুর মা-র হাতের করিশ্মা দেখে যেও৷ মানে খেয়েই দেখো৷

—হা হতোস্মি! যাই একটু স্মোক করেই আসি৷