logo

বিদ্যাস্থানে ভয়

অনিন্দ্য ভুক্ত

এক

ছুটি পড়ে যাচ্ছে আজ থেকেই। তবে ছুটি পড়ার সেই আগের মজাটা এখন আর নেই। আগের মতো লম্বা এক মাসের ছুটি এখন আর পড়ে না। এখন ছুটি দশ থেকে এগারো দিনের মতো। ষষ্ঠী থেকে লক্ষ্মী পুজো। তবু পুজোর ছুটি তো… পুজো এলেই বাঙালি আকাশে পুজো পুজো রং দেখে, বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ পায়।

এখন সবে দুটো বাজলেও কলেজ তাই ভাঙা হাট। ছেলেমেয়েরা ক্লাসে নেই। টিচাররাও তাই একে একে ব্যাগ গোটাতে শুরু করেছে। আজ কলেজও সময়ের বাঁধন রাখেনি। অসিতও তাই উঠব উঠব করছিল। এমন সময়ই বিশু এল, “স্যর…”

কলম থামিয়ে অসিত মাথা তুলল, “কী রে, আয়।” বিশু ঘরে ঢুকে এল। এটা ওদের ডিপার্টমেন্টের নিজস্ব ঘর। প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টেরই আলাদা আলাদা রুম। টিচাররা বসেন। আগে কমন স্টাফ রুম ছিল। এই প্রিন্সিপাল এসে এসব বন্দোবস্ত করেছেন। সবাই খুব খুশি। অসিত শুধু বলে, ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল।’

ঘরে ঢুকে টেবিলের উলটো দিকে দাঁড়িয়ে বিশু হাতের কাগজটা এগিয়ে দিল, “স্যর এটা একটু করে দিয়ে যেতে বললেন।”

হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিতে নিতে অসিত বলল, “বাড়ি যাবি না?”

“কাল সকালে। আসছি স্যর,” বলে বিশু চলে গেল। যেন রাজ্যের কাজ পড়ে আছে তার।

অসিত খাতা-পেন গুটিয়ে উঠে পড়ল। কম্পিউটারে বসতে হবে। ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্টদের রেজিস্ট্রেশন-এর কাগজপত্র। ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে আপলোড করতে হবে। সময় লাগবে। অসিত বুঝতে পারছিল, এটা ওকে কলেজে আরও কিছুক্ষণ আটকে রাখার ফন্দি মাত্র। আজ যেহেতু পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখার রাস্তা নেই, সেজন্য এই বন্দোবস্ত। এতে যে ভদ্রলোক কী আনন্দ পান কে জানে! “পাগলের গো-বধেও আনন্দ,” কম্পিউটারের স্যুইচ অন করতে করতে স্বগতোক্তি করল অসিত।

প্রায় দু’ঘণ্টা টানা কাজ করে যখন উঠল, ঘাড় মাথা তখন টনটন করছে। এতক্ষণ একটানা কম্পিউটারে কাজ করার অভ্যেস ওর নেই। উঠল, অ্যাটাচড বাথরুমে গিয়ে চোখে-মুখে জল দিল, তারপর ডিপার্টমেন্ট লক করে বাইরে এল।

         করিডর দিয়ে হেঁটে অফিসের দিকে যাবার পথে অসিত টের পাচ্ছিল পুরো কলেজ ফাঁকা। ওদের ডিপার্টমেন্ট কলেজের এমন এক কোণে যেখানে না ঢোকে আলো, না ঢোকে হাওয়া, না পৌঁছায় কলেজের কোনও কোলাহল। কেমন যেন এক হালকা আশঙ্কা হল অসিতের, অফিসে আর কেউ আছে তো, নাকি ওর কথা ভুলে গিয়ে সব চাবি মেরে কেটে পড়েছে!

 তিনতলার সিঁড়ির মুখে এসে একটা গাড়ির আওয়াজ পেল অসিত। মানে কেউ একজন বেরচ্ছে। অসিত বলে, গ্যাং অফ সেভেন। প্রিন্সিপাল সহ সাতজনের এই মধুচক্র বসে কলেজ একটু হালকা হয়ে যাবার পর। কোত্থেকে কী ফান্ড আসবে, আর সেই ফান্ড কোন পথে কোথায় পাঠাতে হবে, তার অনুপুঙ্খ পরিকল্পনা তৈরি হয় এই মধুচক্রের বৈঠকে। তারপর এক এক করে বেরতে শুরু করে গাড়িগুলি। অসিত এই মধুচক্রের চক্ষুশূল। গভর্নিং বডির মেম্বার হওয়ার সূত্রে ইদানীং তার ভার সহ্য করতে হচ্ছে এই গ্যাং অফ সেভেনকে। 

 দোতলায় নেমে, অফিসে কাগজপত্র জমা দিয়ে একতলার সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতেই অসিত দেখল আরেকটা গাড়ি বেরচ্ছে। এগুলো কোনটা যে কার গাড়ি অসিত বোঝে না। সব একই মডেলের। রং আলাদা আলাদা অবশ্য। তবে সেসব রঙের পার্থক্য ওর মাথায় ঢোকে না। কার গাড়ি বের হচ্ছে সেটাও বোঝার উপায় নেই। সব গাড়িরই কালো কাচ। বাইরে থেকে বোঝা যায় না ভিতরে কে আছে।

অসিত সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাগানের পাশের রাস্তাতে পা রাখতেই গাড়িটার ড্রাইভারের কাচ নামল, “স্যর, উঠে পড়ুন।” অর্থাৎ গাড়ির মালিক অর্ডার দিয়েছেন। অসিত পারতপক্ষে এসব গাড়িতে ওঠে না। সে পদাতিক। পায়ে হেঁটেই কলেজ যাতায়াত করে। মোটে তো দু’ কিলোমিটার রাস্তা। আজ কী মনে হল, ঘাড়ে মাথায় যন্ত্রণাটা করছে বলেই বোধহয়… অসিত পিছনের দরজার লক ঘোরালো।

 মাথা নীচু করে শরীরটা গাড়ির মধ্যে গলাতে না গলাতেই একটা হাত রুমাল দিয়ে ওর চোখ-মুখ চেপে ধরল। লোকটার মুখে মাস্ক। লোকটাকে চিনে ওঠার আগেই নাকে একটা মিষ্টি গন্ধ পেল অসিত। আস্তে আস্তে ওর চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। 

দুই

পুজোর ছুটির পর সদ্য আজই কলেজ খুলেছে। এবারের পুজো হল বেশ দেরিতে। অক্টোবরের শেষে। তাতেও জলে-কাদায় নাকালের একশেষ। সৌজন্যে বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণাবর্ত, নিম্নচাপ। আর সেই নিম্নচাপের বর্ষার লেজ ধরে গুটি গুটি পায়ে এসে হাজির হালকা শীত।

          কলেজ থেকে ফিরে জমিয়ে চা-মুড়ি খাবার আগে তাই ছোটকা মায়ের কাছ থেকে ওর ঢাউস সুতির চাদরটা চেয়ে নিয়েছে। ভাল করে মুড়িয়ে বসে খেতে খেতে কাগজ পড়বে। কলেজ আমারও খুলেছে। আমি ফিরেছি অনেকক্ষণ আগেই। তবে আগে ফিরলেও বরাবরই আমি টুকটাক খেয়ে কাটিয়ে দিই, ছোটকার সঙ্গে বসে একসঙ্গে মুড়ি খাব বলে।

          একসঙ্গে খাওয়া মানে যে গল্প করতে করতে খাওয়া তা নয়। কাগজটা ভাগাভাগি করে একসঙ্গে পড়ি, পড়তে পড়তে কিছু মনে হলে মন্তব্য করি। গল্পটা জমে খাবার পর চায়ে চুমুক দিয়ে। খাবার মুখে নিয়ে কথা বলাটা ছোটকা বিশেষ পছন্দ করে না।

          তবে সেই গল্পটা আজ আর জমলো না। চায়ে প্রথম চুমুকটা দেবার পরই ছোটকার মোবাইলটা বেজে উঠল। ‘আননোন নাম্বার’, সেটা ছোটকার গলার অনিশ্চিত সাড়া শুনেই বুঝলাম। কিন্তু দু’-এক কথার পর সেটা অন্য দিকে ঘুরে গেল। আর আমি চমকে উঠলাম ছোটকা হঠাৎ করে মোবাইলের লাউড-স্পিকার অন করে দেওয়ায়, যেটা ও করে কোনও কেস চলার সময়।

“কী-রে এখন কেমন আছিস?”

“ভাল নেই অরিন্দমদা। আমার ভীষণ ভয় করছে।”

“আমি শুনলাম। রিনা বলল। তুই ডিটেইলটা বল। আর ভয়ের কী আছে? কিস্যু নেই।”

          কিন্তু ভদ্রলোক তারপর যেটা বললেন, সেটা যে আতঙ্কিত হয়ে পড়ার মতোই ঘটনা তা নিয়ে আমার অন্তত কোনও দ্বিধা রইল না। ভদ্রলোক মানে সুবীরকাকু। কাকু পড়ায় রামনগর নামের এক মফস্বল শহরের কলেজে। জুলজির অধ্যাপক। ওঁর কলেজে এক ভদ্রলোক পড়াতেন। অসিত বসু। অর্থনীতির অধ্যাপক। পড়াতেন মানে, পুজোর ছুটি পড়ার দিন তাঁকে শেষ দেখা গেছে কলেজেই। তারপরই তিনি নিখোঁজ। কলেজের মৌচাকে ঢিল মারার অভ্যাস ছিল তাঁর। ফলে কলেজের মধুচক্রের পাণ্ডাদের তিনি চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন। তারপরই হঠাৎ করে কলেজ থেকেই তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার পর সুবীরকাকুর একটা সন্দেহ হচ্ছিলই। আজ কলেজ খোলার পর ডিপার্টমেন্টে ঢুকেই কাকু দেখে দেওয়ালে একটা নতুন হিউম্যান স্কেলেটন ঝুলছে। দেখেই সন্দেহ শুধু নয়, প্রবল আতঙ্কে অজ্ঞান হয়ে যায় কাকু। কলেজ থেকেই তারপর গাড়িতে করে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এখন বাড়িতে।

 “কিন্তু তোর হঠাৎ এমন উদ্ভট সন্দেহ হল কেন?”

 “আমি ডিপার্টমেন্টের হেড অরিন্দম। এমন কোনও স্যাম্পেলের রিকুইজিশন তো আমি দিইনি।”

ছোটকার মুখটা একটু গম্ভীর হল। ফোনটা খানিকক্ষণ হাতেই ধরে রেখে তারপর বলল, “হতে পারে, তোর ডিপার্টমেন্টের অন্য কেউ প্রিন্সিপালের কাছে গিয়ে ভার্বালি অ্যাপ্রোচ করেছে। জিনিসটা দরকার।” 

“হতে পারে না।”

“কেন? তোদের সিলেবাসে হিউম্যান অ্যানাটমি নেই?”

“আছে।”

“পড়ায় কে? তুই?”

“না আমি নই। অনন্ত।”

“তাহলে তো হতেই পারে।”

“পারে না অরিন্দম। আমি ছাড়া ডিপার্টমেন্টে কোনও পার্মানেন্ট টিচার নেই। সেটা হলেও একটা কথা ছিল।” 

“বেশ, তাই না হয় হল। কিন্তু তোর হঠাৎ মনে হল কেন ওটা অসিতবাবুর স্কেলেটন? অসিতবাবু তো মিসিং।”

          আবার গলাটা কেমন হয়ে গেল সুবীরকাকুর। ফিসফিস করছে। যেন ফোনেই কেউ শুনে ফেলবে। “সেই একই হাইট অরিন্দম। অসিতদার কাঁধটা একটু চওড়া ছিল।” 

         “ধ্যাৎ, যত্তসব। বি নর্মাল সুবীর।” ছোটকা সুবীরকাকুর ভয়টাকে যেন উড়িয়ে দিতে চাইল।

কিন্তু হঠাৎই যেন আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল সুবীরকাকুর গলা। “অরিন্দম, অসিতদার বাঁ-হাতে ছ’টা আঙুল ছিল। সবটাই এমন মিলে যেতে পারে বলছিস!”

         ছোটকার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল।

তিন

গম্ভীর মুখে ছোটকা ফোনটা কেটে দেওয়ার সময়ই বুঝেছিলাম কেসটা এসে গেল। বিনি পয়সার কেস। বন্ধু তো আর পয়সা দেবে না। আর দিলেও ছোটকা নেবে না। তাছাড়া নেশার পিছনে ছোটার জন্য ছোটকা পয়সার তোয়াক্কা করে না। অবশ্য সে আর কেই বা করে নেশার জন্য?

          তবে এবার যে কিঞ্চিৎ ছোটাছুটি আছে সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। রামনগর কলকাতা থেকে আশি-নব্বই কিলোমিটার হবে। একবার গিয়েছিলাম ছোটকার সঙ্গে। সুবীরকাকুর বাড়িতেই উঠেছিলাম। ছোটাছুটি আছে এ-ও যেমন বুঝছিলাম, তেমনই ফোনটা রাখার পর ছোটকার ক্রমশ কুঁচকে ওঠা ভুরু থেকে বুঝতে পারছিলাম, ছোটাছুটি শুরু হবার দেরিও আর নেই।

         তবে সেটা যে এত তাড়াতাড়ি তাও বুঝতে পারিনি। সন্ধের পর থেকে ছোটকা আর আমার সঙ্গে কথা বলেনি। রাতে খাবার টেবিলে বসে বলল, “খেয়ে উঠে একবার দেখিস তো, সকালের দিকে রামনগর যাওয়ার কী বাস আছে এসবিএসটিসি-র।” 

         ব্যাস, ওই একটাই কথা। আমিও আর কথা বাড়াইনি। বুঝতে পারছিলাম, ও গভীরভাবে ভাবছে। খেয়ে উঠে এসবিএসটিসি-র অ্যাপটা খুলে ওকে সকালের দিকের বাসের টাইমগুলো জানাতে ও বলল, “সাড়ে ছ’টার বাসের টিকিট বুক করে নে।” 

রামনগর কলেজটা বেশ বড়। একটা মফস্বল শহরে যে এত বড় একটা কলেজ থাকতে পারে সেটা না দেখলে বিশ্বাস হত না। অথবা মফস্বল শহর বলেই হয়তো বা এত বড় কলেজ। কলকাতা শহরে এতটা জায়গা পাবে কোথায় কোনও কলেজ? 

          সুবীরকাকুকে বলাই ছিল, আমরা বেশিক্ষণ থাকব না। তাই ও যেন দেরি না করে। বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষা না করে আমরা তাই একটা টোটো ভাড়া করেই চলে এসেছি। টোটোর ভাড়া মেটাতে মেটাতে কাকু বলল, “দশ বছর আগেও কিন্তু কলেজ এত বড় ছিল না। আমি এসেও চালাঘরে ক্লাস করেছি। সব এই প্রিন্সিপালের উদ্যোগ।”

         “করিৎকর্মা লোক বলতে হবে তাহলে,” ছোটকার মন্তব্য শুনে সুবীরকাকু ম্লান হাসল। “চলো, তোমাদের ডিপার্টমেন্টে বসিয়ে আমি স্টাফ-রুমে সইটা সেরে আসব। সময়টা নষ্ট হবে না।”

“সই! কীসের সই?”

“অ্যারাইভালের। তোমরা এসব আর কী বুঝবে অরিন্দমদা? পাঁচ ঘণ্টা এখানে বন্দি হয়ে থাকা কম্পালসারি। ক্লাস থাকুক আর নাই থাকুক।”

          ছোটকা চুপ করে গেল। কলেজ নিয়ে সুবীরকাকুর চাপা ক্ষোভটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। সেটাকে খামোখা ঘাঁটিয়ে তোলার কোনও মানে হয় না।

         সুবীরকাকুর ডিপার্টমেন্টটা দোতলায়। ল্যাব-বেসড ডিপার্টমেন্ট বলে নন-টিচিং অ্যাটেনডেন্টও আছে। তাদের সঙ্গে, “আমার বন্ধু, অরিন্দমদা কলকাতার কলেজে আছে, বেড়াতে এসেছিল, আমাদের কলেজটা একটু দেখে ফিরে যাবে,” বলে আমাদের পরিচয় করে দিয়ে কাকু সই করতে চলে গেল।

 দুটো বিশাল বড় ঘর জুড়ে ডিপার্টমেন্ট। তুলনামূলকভাবে ছোট ঘরটায় টিচাররা বসেন, আমরা এখন যে ঘরটায় দাঁড়িয়ে। ছোটকা বসেনি। ঘুরে ঘুরে দেখছে। উদ্দেশ্যটা আমি জানি। তবে যার জন্য ঘোরা, সেটা চেয়ারে বসেই দেখা যাচ্ছিল। ছোটকা সেদিকে গেলই না। পাশের ঘরটায় যাবার একটা দরজা ভিতর দিয়েই ছিল। সেই ঘরে ঢুকে এল ও। সারা ঘরে কত রকম প্রাণীর দেহাংশ, ফরমালডিহাইডে চোবানো। একজন ল্যাব-অ্যাটেনডেন্ট আমাদের সঙ্গেই ঘুরছিলেন, নাম বললেন দিবাকর। ডিপার্টমেন্টের এক কোণেই চায়ের বন্দোবস্ত আছে। আরেকজন সেখানে ইতিমধ্যেই চা চাপিয়ে দিয়েছেন। ঘুরতে ঘুরতেই ছোটকা টুকটাক প্রশ্ন করছিল।

দুটো ঘর প্রায় পুরোটা দেখে ও স্কেলেটনটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আমার গা শিরশির করছিল। “বাব্বা, হিউম্যান স্কেলেটনও কাজে লাগে!” ছোটকা নকল বিস্ময় প্রকাশ করল। দিবাকর জবাব দিল, “এতদিন ছিল না। পুজোর পরেই এসেছে।” ছোটকা দাঁড়াল। দেখল। তারপর চেয়ারে গিয়ে বসল। সুবীরকাকু চলে এল। “চল তোকে কলেজটা ঘুরিয়ে দেখাই। সময় হবে না আর। প্রিন্সিপালও একবার দেখা করে যেতে বললেন।” কথাগুলো একটু উঁচু গলাতেই বলল কাকু। উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার। চা খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

বিশাল এলাকা জুড়ে কলেজ। সবটা দেখার আগ্রহ ছোটকার ছিল না। কিন্তু অসিতবাবুর ডিপার্টমেন্টটা শুধু দেখতে গেলে সন্দেহ বাড়বে। সুবীরকাকু তাই সবটাই বুড়ি ছোঁয়া করছিল। দু’-চার জনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। অসিতবাবুর ডিপার্টমেন্টটা দেখলাম। এক কোণে। নির্জনে। এখানেই কেউ খুন করে ফেলে রেখে দিলে সহজে জানাজানি হত না।

কলেজ ঘুরে আমরা প্রিন্সিপালের ঘরে ঢুকলাম। সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে আহ্বান করলেন। ঘরে ঢুকতেই যেদিকে চোখ পড়ল সেটা একটা পেল্লাই মনিটর। মনিটরের পর্দার ছোট ছোট ঘরে কলেজের টুকরো টুকরো ছবি ভেসে উঠছে। পুরো কলেজটাই যে সিসিটিভি-তে মোড়া সেটা আগেই লক্ষ করেছি।

ছোটকা বসার পর সৌজন্য বিনিময় হল, চা জলখাবারের অর্ডার হল। তারপর ছোটকা বলল, “বিশাল কলেজ দেখলাম, অসাধারণ ক্যাম্পাস।” ভদ্রলোকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, “তাও কতটাই বা সময় পেয়েছি বলুন, বছর দশেক। কী ছিল কলেজটা! আমি যখন আসি সুবীরবাবুরা তখন টিনের চালা-ঘরে ক্লাস নিতেন, কুকুর-ছাগল ক্লাসে ঢুকে বসে থাকত।”

সুবীরকাকু দেখলাম সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে প্রিন্সিপাল স্যর বললেন, “ঘাড় না নেড়ে আর কী করবে সুবীর, সত্যিটা তো আর অস্বীকার করা যায় না। এটা আমার জায়গা। এখানে আমার জন্ম-কম্ম। যে ক’দিন আছি, কলেজটাকে আরও বড় করে যাব, সে তোমরা যতই বাধা দাও।”

ভদ্রলোকের গলায় ভূমিপুত্রের অহংকার। কিন্তু হাসি মুখে এমন মসৃণ মোলায়েম ভঙ্গিতে বলছেন, তর্ক করার কোন‌ও জায়গা নেই। ছোটকা কথা ঘোরাল, “আপনার একজন টিচার শুনলাম মিসিং।”

“কে বলল, আপনার বন্ধুটি তো? কী করব বলুন, সাধে কি আর সুবীররা আমাকে অপয়া বলে! আমি জয়েন করার পর চারটে অকালমৃত্যু, তিনটে সুইসাইড। এখন আবার এই মিসিং এপিসোড…”

   হাসি মুখে বলতে বলতেই গম্ভীর হয়ে গেলেন ভদ্রলোক, “ভেরি আনফরচুনেট ইভেন্ট প্রফেসর সেন। আমরা সবাই খুব আপসেট হয়ে পড়েছি। আমার সঙ্গে অসিতের একটা অম্লমধুর সম্পর্ক ছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা প্রফেশনাল জায়গা থেকে। পার্সোনাল লাইফে ও আমার খুব কাছের ছেলে ছিল, ভাইয়ের মতো। ইন ফ্যাক্ট, আমার মিসেস তো খুব ডিপ্রেসড হয়ে পড়েছেন। অসিত আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ডের মতো ছিল। ওরকম ওয়াইজ, অনেস্ট ফ্রেন্ড পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার প্রফেসর সেন। তাছাড়া আপনি জানবেন, সারা পশ্চিমবঙ্গ এই কলেজকে চেনে অসিতের কারণে। ‘অসিত বসু আপনার কলেজেই আছেন তো?’ এই প্রশ্ন আমাকে অনেকেই করে। আফটার অল, ওর লেখক হিসেবে খ্যাতি তো কেউ অস্বীকার করতে পারে না।”

    চেয়ারটা পিছন দিকে হেলিয়ে দিয়ে, হাত দুটো জড়ো করে মাথার পিছনে নিয়ে গেলেন সুভদ্র দফাদার, রামনগর কলেজের দোর্দণ্ডপ্রতাপ অধ্যক্ষ। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

 “পুলিশ কী বলছে?” ছোটকা প্রশ্ন করল‌। প্রশ্নটা শুনে চেয়ার আবার সোজা হল। “কী আর বলবে? যেমন বলে, ইনভেস্টিগেশন চলছে। ওদের বিশ্বাস, ইন ফ্যাক্ট আপনার বন্ধুদের‌ও বিশ্বাস এর পিছনে আমাদেরই এক প্রাক্তন সহকর্মীর হাত আছে।”

“প্রাক্তন সহকর্মী বলতে?”

“ভদ্রলোক অন্য কলেজে চলে গেছেন। তবে ঘটনার দিন উনি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। বকেয়া পাওনাগণ্ডা আর কী। কিন্তু তাতে কী? উনি কি আর অসিতকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যাবেন? যত্তসব।”

“ভদ্রলোকের নাম?”

“প্রকাশ রায়।”

 চেয়ার আবার পিছনে হেলে গেল। হাত মাথার পিছনে। অর্থাৎ ভদ্রলোকের এটি পছন্দের পসচার। কিছু ভাবছেন। চুপ ছোটকাও। ভাবছে। আচমকাই চেয়ার সোজা হল। 

“আচ্ছা প্রফেসর সেন, আপনি তো শুনেছি প্রাইভেটলি টুকটাক ইনভেস্টিগেশন করেন। বেশ সাকসেসফুল‌ও। পুলিশ যা করছে করুক, আপনি একটু নেড়ে ঘেঁটে দেখতে পারেন না?”

  “যাব্বাবা, এটা কী হল!” আমার বিস্ময়ের মধ্যেই দেখলাম, ছোটকা ঘাড় নাড়ছে, “না না। ও একেবারেই শখের ব্যাপার। তাছাড়া আমার কলেজ থাকে। কলকাতার মধ্যে কিছু হলে চাকরি বাঁচিয়ে একটু-আধটু চেষ্টা করি আর কী।”

 সুভদ্র দফাদারের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠছে, “প্রফেসর সেন, টাকাকড়ি হয়তো আপনাকে আমি কিছু দিতে পারব না। আপনি জানেন, কলেজ ফান্ড থেকে সেটা দেওয়াও সম্ভব নয়। তবে আপনি যদি উইক এন্ডের সঙ্গে দু’-একদিন জড়ো করে ইনভেস্টিগেশন করতে রাজি হন, তাহলে কলেজের গেস্ট হাউসে আপনার থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্তটা করা যায়।”

   মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে ছোটকার‌ও। “স্যর, আপনার হয়তো জানা নেই, টাকাপয়সার কথা ভেবে এসব কাজ আমি করি না। এটা আমার শখ। তবে হ্যাঁ, টাকাপয়সা আমি নিই। কিন্তু ওটা না থাকলে আমি কাজ নেব না এটাও যেমন ঠিক নয়, ওটা পকেট ভর্তি করে দিলেই কাজ নেব এটাও নয়। এই কাজটা করতে পারলে আমার ভাল লাগত। আফটার অল, সুবীর খুব আপসেট হয়ে পড়েছে। কিন্তু এটা করা প্র্যাকটিক্যালি একটু ডিফিকাল্ট। তাছাড়া পুলিশ তো দেখছে। ওরা দেখুক না। আমি না হয় ওপর মহলে একটু বলে রাখব। আমাদের পুলিশ কিন্তু খারাপ নয়। ইচ্ছে করলে ওরা সব পারে। পলিটিক্যাল প্রেসার বা ইন্টারফিয়ারেন্সটা না থাকলে কিন্তু…”

   ছোটকা গম্ভীরমুখে চুপ করে গেল। আমি জানি ও কেন বাক্য সম্পূর্ণ করল না। ভদ্রলোকের পলিটিক্যাল পাওয়ারের কথা সুবীরকাকু আমাদের আগেই বলেছে। অবশ্য না বললেও আজ পশ্চিমবঙ্গে এটা সবাই জানে। প্রিন্সিপাল, ভিসি—এগুলো এখন সব পলিটিক্যাল চেয়ার। পেটে বিদ্যে বুদ্ধি বিশেষ না থাকলেও চলে।

  প্রিন্সিপালের চেয়ার আবার পিছনে হেলল। “বেশ। আপনাকে তো আর আমি জোর করতে পারি না। খবর তো আপনি সুবীরের কাছে পাবেন‌ই। যদি আপনার মনে হয়… ইউ আর অলওয়েজ ওয়েলকাম প্রফেসর সেন।”